Posts

জল

তোমায় ভালোবেসেছি আমি, তাই অন্ধকারে ঘাসের গন্ধ পাই; কালো বেতের ফলে নিবিড় দিন কোথার থেকে আবার এলো ভেসে। মনে পড়ে, জলের মতন ঘুরে অবিরল পেয়েছিলাম জামের ছায়ার নীচে তোমার জল, যেন তোমার আমার হাজার-হাজার বছর মিল, মনের সঙ্গে শরীর যেমন মেশে; মৃত্যু এলে, ম’রে যেতে হবে ভালোবাসা নদীর জলের মতন হ’য়ে রবে, জুলের থেকে ছিঁড়ে গিয়েও জল জোড়া লাগে আবার যেমন নিবিড় জলে এসে। দেশ। ১২ চৈত্র ১৩৬৬

চিঠি এল

কত বছর পর তোমার চিঠি পেলাম আবার: এই সকাল বেলার রৌদ্রে আমার হৃদয়ে বারুণীর কোটি-কোটি সহচরী তিমির পিঠ থেকে মকরের পিঠে আছড়ে প’ড়ে নটরাজ্ঞীদের মতো মহান সমুদ্রের জন্ম দিল। আমি মুদ্রিত চোখ নিয়ে তোমাকে অনুভব করি, মনে হয় যেন সূর্যাস্তের জাফরান আলোয় সাদা গোলাপের বাগান ছড়িয়ে রেয়েছে মাইলের-পর-মাইল, একটা সজনে-গাছও নেই, তাই বিরাট আকাশ-চিল উড়ে এসে শূন্য বাতাসের ভিতর আঁকাবাঁকা ব্যর্থ জ্যামিতির দাগ রেখে গেল শুধু, তারপর দূর নীড়ের দিকে উড়ে গেল হৃদয়ের পানীয়ের দিকে। সমস্ত কলরব ও আলোর থেকে ফিরে এসে সমস্ত জনতা এড়িয়ে— এক কিনারে— অন্ধকারে— তুমি আমার পাশে এসে বসলে মনে হল যেন সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দ পেয়েছে যেন বক-নারী একটা উঁচু গাছের উঁচু ডালের থেকে আরও উঁচু ডালের দিকে উড়ে এল সে বিছানো ডানার প্রতিটি পালকের খাঁজে-খাঁজে শঙ্খসাদা অব্যবহৃত আস্বাদ নিল অবিজ্ঞানের প্রচুর ঘুম নিয়ে নিজেকে ব্যবহার করতে এল শান্ত রাত্রির পবিত্রতার ভিতর। তোমার মুখ নিরপরাধ সাদা পাখির মতো সুন্দর কিন্তু কোনও বিরাট আকাশ-পাখির মতো তির্যক চোখে আমি যদি তাকাই মনে হয় যেন দানবী-রূপসির হাতে প্রান্তরের অন্ধকার রাত্রি দাঁড়িয়ে রয়েছে আমার সমস...

নদী নক্ষত্র মানুষ

‘এখানে জলের পাশে বসবে কি? জলঝিরি এ-নদীর নাম; অপরূপ; আমি তবু ঝাউবনী বলি একে’— আস্তে বললাম। নদীর দুপারে ঢের উঁচু-উঁচু ঝাউবন, নীড়— চুপচাপ ঘাসের উপরে ব’সে কিছুক্ষণ তারপরে আমরা দুজনে কোনো কথা খুঁজে তবু পেলাম না আর যেন— নদী যেন ঢের দূরে— আমাদের মনে এ-মুহূর্ত এ-আকাশ নেই আর আজ; বিষণ্ণতা: তাও নেই— পাতা ঝরবার স্বর শুনি, ঢেউ নড়বার শব্দ পাই; এই পৃথিবীতে যেন কিছু নেই আর। একদিন— জানি আমি— সম্পূর্ণ আকাঙ্ক্ষা ছিলো আমাদের মনে; ‘নক্ষত্রের নিচে শিশিরের গল্প শোনায়েছি শুনেছি দু’জনে চোখাচোখি ব’সে থেকে; হাতে হাত নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাস না জানতে মিশে গেছে— যেমন মাটির গন্ধ হৃদয়ে ফোটাতে চায় ঘাস, ধান খই দূর্বাঘাসে যেমন মাটির ইচ্ছা নিজেকে রাখতে চায় ঢেকে একদিন পৃথিবীর বিলোড়ন রৌদ্র রিক্ত আহ্বানের থেকে দূরে স’রে প্রেম আর আকাঙ্ক্ষার ঘরে ব’সে আমাদের ব্যাপৃত হৃদয় আকাশ ও এ-মাটিকে পেয়েছিলো এক তিলে— ‘ বললাম; আস্তে তখন সে বললে— ‘শেষ সত্য নদী নয়,— মন— ‘ আমি তাকে: ‘হয়তো নতুন কোনো রূপে আমাদের ভালোবাসা পথ কেটে নেবে এই পৃথিবীতে;— আমরা দুজনে এই বসে আছি আজ— ইচ্ছাহীন;— শালিক পায়রা মেঘ পড়ন্তবেলার এই দিন চারিদিকে; এখানে গাছের পাতা যেতে...

শান্তি ভালো

গুলি খেয়ে শূন্যে মৃত্যু হবার আগে পাখি যেমন তাহার সুস্থ দেহের পাখিনীকে দেখে কামের পরিতৃপ্তি খুঁজে আকাশে উড়ে যায় অন্ধকারে পাখি শরীর ছেড়ে দিতে শেখে— অবাধগতি ঢিলের মতন ঘাস-পাথরের পানে; তেমনই আলো-অন্ধকারের মরণ-জীবনের মোহনা থেকে তোমাকে ভালবেসে শান্তি ভালো: শান্তি ভালো, উড়েছি আমি ঢের। অনেক পথ চলা হ’ল— তবুও আমি আজও পেয়েছি যা— চেয়েছি সেই চক্রবলের রেখা? সাত-আট বছর পরে আবার বনচ্ছবির সাথে শীত সামাজিক রাত্তিরে আজ দেখা। জীবন আমার সমাহিত অনেক দিনের থেকে; নদী মাঠে ঘাটে শিশিরবিন্দুতে উৎসুক হয়ে হৃদয় সফলতায় দিন বা রাত্রি এলে বলেছে: এই স্পষ্ট শান্ত প্রবাহ আসুক। নারীরা আসে, হারিয়ে যায়— ধীর জগতের সাথে জেগে থেকে পেয়েছি আমি বিষয়স্থিরতা কিছু ভাষা পৃথিবীকে দেবার— বাকি সবই নিহিত হয়ে ব’সে থেকে গ্রহণ করার কথা নদী শিশির সূর্য বৃক্ষ থেকে, চারি দিকে আকাশ ভ’রে হয়েছে উদয় সকল কালের বার্তাবহ নক্ষত্রদের আভা ব্যর্থ হয়ে তবুও মানব গল্প স্নিগ্ধ হয়। আনন্দবাজার পত্রিকা। শারদীয় ১৩৬২

তোমাকে

ভেবেছিলাম এ-কথা স্থির মেনে নিতে পারি: নিউট্রন ও ইলেকট্রনের অন্ধ সাগরে ওদেরই জাদুবলে তুমি হয়েছ আজ নারী; ওদেরই দয়ার ফলে আমি প্রেমিক তোমার তরে। তবু এ-ভুল হৃদয়ঙ্গম— মহাসৃষ্টির মানে হয়তো ঠিক এমনভাবে উৎসারিত নয়। তা যদি হ’ত তবে যেদিন নিজেরই পরামর্শে সজ্ঞানে আমাকে তুমি দিয়েছিলে অব্যর্থ হৃদয়; সে স্বাদ হয়ে যেত কি আজ হেমন্তে আবার ক্ষয়। শীতের পড়ি-পড়ি বেলায় ফসল কেটে নিচ্ছে চাষা ঘরে; নদীর বুকে প্রকৃতি জল রেখেছে, তবু রক্তের উদয় এসে সবই আচ্ছাদিত করে। এ-শতকে মানুষ নারী শূন্য হ’তে এসে চলছে শূন্যে— আঁধার থেকে অপরিসীম আরও অন্ধকারের ভেতর গিয়ে মেশে। এ-ছাড়া কোনও সত্য নেই— উপায় নেই কারও। এরই ভিতর অন্য এক গভীরতর নিরুপায়তা আছে; মানুষ ও তার চিরস্থায়ী মানবছায়া ছাড়া জানে না কেউ; প্রলম্বিত নীল আকাশের কাছে কোনও দিনও পৌছুবে না কোনও সাড়া। তবু সবই ঠিক হয়েছে; কবের আদি পৃথিবী থেকে তুমি কত গ্লানি রক্ত আঁধার বিহ্বলতার থেকে চলেছ আজও তিলধারণের মতন পটভূমি দান না ক’রে— নিজেরই গালে সে তিলবিন্দু রেখে। বর্ধমান। শারদীয় ১৩৬১

অনির্বাণ

সর্বদাই এরকম নয়, তবু মাঝে মাঝে মনে হয় কোন দূর উত্তরসাগরে কোনো ঢেউ নেই; তুমি আর আমি ছাড়া কেউ সেখানে ঢোকার পথ হারিয়ে ফেলেছে। নেই নীলকণ্ঠ পাখিদের ডানা-গুঞ্জরণ ভালোবেসে আমাদের পৃথিবীর এই রৌদ্র; কলকাতার আকাশে চৈত্রের ভোরে যেই নীলিমা হঠাৎ এসে দ্যাখা দেয় মিলাবার আগে এইখানে সে-আকাশ নেই; রাতে নক্ষত্রেরা সে-রকম আলোর গুঁড়ির মতো অন্ধকার অন্তহীন নয়। তবুও আকাশ আছে: অনেক দূরের থেকে নির্নিমেষ হ’য়ে নক্ষত্র দু’-একজন চেয়ে থাকে; চেয়ে থাকে আমাদের দিকে— যেন টের পায় পৃথিবীর কাছে আমাদের সব কথা— সব কথা বলা ডাভেন্ট্রিডোমেই টাসে স্টেফানিতে যুদ্ধ শান্তি বিরতি নিয়তির ফাঁদে চিরদিন বেধে গিয়ে ব্যহত রণনে শব্দের অপরিমেয় অচল বালির— মরুভূমি সৃষ্টি ক’রে গেছে; —কোনো কথা কোনো গান কাউকেই বলে নাই; কোন গান পাখিরাও গায় নাই। তাই এই পাখিহীন নীলিমাবিহীন শাদা স্তব্ধতার দেশে তুমি আর আমি দুই বিভিন্ন রাত্রির দিক থেকে যাত্রা ক’রে উত্তরের সাগরের দীপ্তির ভিতরে এখন মিশেছি। এখন বাতাসে শব্দ নেই— তবু শুধু বাতাসের শব্দ হয় বাতাসের মতো সময়ের। কোনো রৌদ্র নেই, তবু আছে কোনো পাখি নেই, তবু রৌদ্রে সারাদিন হংসের আলোর কণ্ঠ র’য়ে গেছে, কোন রাণী নেই— তবু ...

আজ

কেবলি আরেক পথ খোঁজো তুমি; আমি আজ খুঁজি নাকো আর; পেয়েছি অপার শুন্যে ধরবার মতো কিছু শেষে আমারই হৃদয়ে মনে: বাংলার ত্রস্ত নীলিমার নিচে ছোটো খোড়ো ঘর— বনঝিরি নদী চলে ভেসে তার পাশে; ঘোলা ফর্সা ঘূর্ণি জল অবিরল চেনা পরিজনের মতন; কখনো বা হ’য়ে আসে স্থির; মাঠ ধান পানবন মাছরাঙাদের আলোড়ন আলিঙ্গন করে বিছিয়েছে তার নারীর শরীর। ঘরে কোনো লোক নেই— কয়েকটি গ্রন্থ তবু আছে; রয়েছে পরম ছবি— চার জন-পাঁচ জন একান্ত শিল্পীর: ফ্রান্সের ইটালির বাংলার কাঙড়ার;— নিম জাম নাগেশ্বর গাছে রয়েছে অগণ্য সব পাখিদের নীড়। তবুও মনকে ঘিরে মহাজাগতিক আলোড়ন আর এই পৃথিবীর অন্তহীন দ্বিধা দ্বেষ প্রেম সংগ্রাম আমাদেরো রক্ত দিয়ে আদি রক্তবীজের নিধন চেয়েছে,— মিটিয়ে দেবে ষোলো আনা দাম। এই শতকের দিন ক্ষয় হ’য়ে এলো প্রায় আজ; নবীন আশার বার্তা নীল নিরালম্ব শূন্যে ভেসে মানুষ যা চেয়েছিলো সেই নারী সেই সূর্য আর সে সমাজ দেবে— তার আত্মঘাতী রণাঙ্গন একদিন স্তব্ধ হ’লে শেষে। আনন্দবাজার পত্রিকা। ১৪ কার্তিক, ১৩৬১

এখন ওরা

এখন ওরা ভোরের বেলা সবুজ ঘাসের মাঠে হো হো ক’রে হাসে— হো হো হি হি করে, অসংখ্যকাল ভোর এসেছে— আজকে তবু ভোরে সময় যেন ঘোড়ার মতো নিজের খুরের নাল হারিয়ে ফেলে চমকে গিয়ে অনন্ত সকাল হয়ে এখন বিভোর হয়ে আছে; মাঠের শেষে ঐ ছেলেটি রোদে শুয়ে আছে ঐ মেয়েটির কাছে। অনেক রাজার শাসন ভেঙ্গে গেছে; অনেক নদীর বদলে গেছে গতি; আবহমান কালের থেকে পুরুষ-এয়োতি এই পৃথিবীর তুলোর দণ্ডে সোনা সবার চেয়ে দামি ভেবে সুখের সাধনা নষ্ট করে গিয়েছে তবু লোভে; ওরা দু’ জন ভালোবাসে অনন্ত ভোর ভ’রে এ-ছাড়া আজ সকল সূর্য ডোবে। পূর্বপত্র। ভাদ্র ১৩৬৭

সে

আলো যেন কমিতেছে— বিস্ময় যেতেছে নিভে আরও আকাশ তেমন নীল? আকাশ তেমন নীল নয় মেয়েমানুষের চোখে নাই যেন তেমন বিস্ময় মাছরাঙা শিশুদের পাখি আজ; শিশুরাও কারও রেশমি-চুলের শিশু নয় আজ; ভাবিতে কি পার প্রেমে সেই রঙ আছে? আঘাতে রয়েছে সেই ভয়? কুয়াশায় সেই শীত? কে সাজায়, কে করে সঞ্চয় আজ আর! জীবন তবুও যেন হয়েছে প্রগাঢ় নতুন সৌন্দর্য্য এক দেখিয়াছি— সকল অতীত ঝেড়ে ফেলে— নতুন বসন্ত এক এসেছে জীবনে শালিখেরা কাঁপিতেছে মাঠে-মাঠে— সেইখানে শীত শীত শুধু— তবুও আমার বুকে হৃদয়ের বনে কখন অঘ্রান-রাত শেষ হ’ল— পৌষ গেল চ’লে যাহারে পাই নি রোমে বেবিলনে— (কাঞ্চী বিদিশায়) সে এসেছে ব’লে। উত্তরসূরি। পৌষ ১৩৬৩

রাত্রি ও ভোর

শীতের রাতের এই সীমাহীন নিস্পন্দ গহ্বরে জীবন কি বেঁচে আছে তবে! ডানাভাঙা নক্ষত্রের মতন উৎসবে আঁধারের ভিতরে কি ঝরে কেবলই স্ফূলিঙ্গ অন্ধ সংক্রান্তির মতো? বহুদিন ক্ষমাহীন সময়ের ভিতরে সে অনেক জ্বলেছে। আছে, তবু তুমি নেই, তাই তো দাহন ভেঙে গেছে। মৃত নক্ষত্রের গন্ধ ক্রমেই হতেছে পরিণত অন্ধকার সনাতনে।— সৃষ্টির প্রথম উৎসারিত পটভূমি তারই অন্তিমের কথা? অন্তহীন মোজেইকে আলোকের গোলকধাঁধায় কেউ প্রিয়া— কেউ তার অনির্বাণ প্রিয় হ’তে চায়; ঝ’রে যায়,— দূর মৃগতৃষ্ণিকার মতো দীপ্ত তুমি। এখন ভোরের বেলা মনে হয় তুমি সাদা যূথিকার মতো। তেমনই পবিত্র স্বাদ তোমার শরীর-শিখা ঘিরে। কোথাও বিষয় খুঁজে তোমাকে দেখেছি রৌদ্রে লুকানো শিশিরে; সৃষ্টির প্রথম ভোর থেকে অবশেষে আজ এই পরিণত শেষ ভোর, শেষ রোদ, শেষ ফুল, অন্তিম শিশির। মীন-কেতনের দিন জন্মান্তরে কেটে গেছে;— আজ প্রতিসারী আরেক প্রয়াণে উৎস;— একটি মেঘের মতো চ’লে এসে তারই নীলিমায় মিশে যেতে— থেমে— শুনেছি, বলেছ তুমি স্থির মেঘশান্তি প্রকৃতির;— মানুষ তা হারায়ে ফেলেছে। চারি দিকে সময়ের সকল বিশাল মরুভূমি বলয়িত নগরীর সমাজের সভ্যতার কলঙ্ক-সুন্দর মৃগতৃষ্ণিকায় লয় পেয়ে গেলে স্থির তুমি— স্থিরতর তু...