এখন অনেক রাতে বিছানা পেয়েছো। নরম আঁধার ঘর শান্তি নিস্তব্ধতা; এখন ভেবো না কোনো কথা। এখন শোনো না কোনো স্বর। রক্তাক্ত হৃদয় মুছে ঘুমের ভিতর রজনীগন্ধার মতো মুদে থাকো।
(আমার হাতের কাজ ফুরিয়ে গেছে আজ আমার হাতের কাজ ফুরিয়ে গেছে-) শিশিরে অন্ধকারে পেঁচা ডাকছে ঐ গাছে ঐ রবার-গাছের ডালপালা সরসর করছে কোনও আকস্মিক বাতাসের সঙ্গে তবুও সে আসবে না আসবে না আর এখন মশারি ফেলবার সময় এখন ঘুমের সময় কমলা রঙের গহন স্বপ্ন যদি আমার মাথার ভিতর খেলা করে যদি রঙিন কাচের জানালা তৈরি হয় তৈরি হয় নদীর তীরের রহস্যময় প্রাসাদ আমার মাথার ভিতরে কোনও আকস্মিক বাতাসের সঙ্গে তবুও সে আসবে না তবুও সে আসবে না আর।
এইখানে প্যাকাটির মতো সব ধঞ্চের গাছগুলো— দাঁড়ায়ে রয়েছে আজও, আহা পাশে নদী— রুগ্ন প্রসূতির মতো চলে এইখানে গত-বছরের এক নরম অঘ্রানে পড়ন্ত রোদের মাঠে— মিঠা মৃদু ঘাসে বিকেলবেলার এক বিশাল আকাশে আমরা ক’ জনে বনভোজনের সঙ্গী এই মাঠে বনে সোনালি রোদের ঢেউয়ে মাছির মতন শিহরনে খেলা ক’রে গেছিলাম আজও এক নরম অঘ্রান আজ আমি একা শুধু আসিয়াছি সেই মেটে কালো হাঁড়ি কাঠের সে রুখু খুন্তিখান সেই ভাঙা উনুনের মাটি পোড়াকাঠ— কয়েকটা রিক্ত কলসি বাটি মাটির গেলাস বাদামি রঙের দগ্ধ ঘাস আজও আছে এখানে ওখানে ছড়ায়ে নীরব আচ্ছন্ন পায়ে হেঁটে-হেঁটে দেখি আজও এক নরম বিকেল মাঠে-মাঠে প্রচুর অঘ্রান গত-বছরের সেই স্থান আজ তবু অমেয় নীরব কয়েকটা সুদর্শন ডেকে উড়ে গেছে গাঙচিল ডেকে গেছে— এই— এই সব চড়ুইভাতির মাঠ বিষণ্ন নীরব দুই জন পেয়ে গেছে সরকারি কাজ লখ্নৌয়ে বেরিলিতে আছে তারা আজ খিদিরপুরের ডকে এক জন আছে বাকিটি— সে— নারী— আহা— হয়তো এ ধর্মেতর গাছে বাতাসে ভাসিছে তার প্রাণ গত-মাঘে মারা গেছে হয়তো ভোলে নি আজও এই বনভোজনের স্থান… শোনো তার গান ধঞ্চের গাছে-গাছে মর্মর— মর্মর হয়তো-বা বাতাসের স্বর।
‘আকাশের চাঁদ, বুড়ি হয়ে গেছ তবু জাগিতেছ অদ্ভুত অবাধ পৃথিবীর দিকে চেয়ে একা-একা হিম জ্যোৎস্নায় কী দেখিছ, হায়’ ‘ভয়— ঘৃণা— বিশৃঙ্খলা কত জানো না কি? তুমিও জানো তো মনে ভাবি তোমাদের পৃথিবীর মতো একটিও তারা যেন কোনও দিন আর তার দীপ না জ্বালায়-‘ ‘আকাশের চাঁদ, কী-যে বলো— পৃথিবীর জীবনের গভীর আস্বাদ একা-একা হিম জ্যোৎস্নায় তুমি কি বুঝিবে বলো, হায়!’ ‘গভীর আস্বাদ?… মাছরাঙা কাঁচপোকা ফড়িঙের মতো পৃথিবীর চলা-ফেরা সব যদি হত তা হলে খানিক হত— খানিক উন্নত হত সব,— কিন্তু থাক— আশা নাই যত দিন মানুষ এ-পৃথিবী চালায় তোমাদের পৃথিবীর মতো আর-একটিও তারা যেন কোনও দিন দীপ না জ্বালায়।’
মনে হয় প্রাণ এক দূর স্বচ্ছ সাগরের কূলে জন্ম নিয়েছিল কবে; পিছে মৃত্যুহীন জন্মহীন চিহ্নহীন কুয়াশার যে-ইঙ্গিত ছিল— সেই সব ধীরে-ধীরে ভুলে গিয়ে অন্য এক মানে পেয়েছিল এখানে ভূমিষ্ঠ হ’য়ে— আলো জল আকাশের টানে; কেন যেন কাকে ভালোবেসে। মৃত্যু আর জীবনের কালো আর সাদা হৃদয়ে জড়িয়ে নিয়ে যাত্রী মানুষ এসেছে এ-পৃথিবীর দেশে; কঙ্কাল অঙ্গার কালি— চারিদিকে রক্তের ভিতরে অন্তহীন করুণ ইচ্ছার চিহ্ন দেখে পথ চিনে এ-ধুলোয় নিজের জন্মের চিহ্ন চেনাতে এলাম; কাকে তবু? পৃথিবীকে? আকাশকে? আকাশে যে-সূর্য জ্বলে তাকে? ধুলোর কণিকা অণুপরমাণু ছায়া বৃষ্টি জলকণিকাকে? নগর বন্দর রাষ্ট্র জ্ঞান অজ্ঞানের পৃথিবীকে? যেই কুজ্ঝটিকা ছিল জন্মসৃষ্টির আগে, আর যে-সব কুয়াশা রবে শেষে এক দিন তার অন্ধকার আজ আলোর বলয়ে এসে পড়ে পলে-পলে; নীলিমার দিকে মন যেতে চায় প্রেমে; সনাতন কালো মহাসাগরের দিকে যেতে বলে। তবু আলো পৃথিবীর দিকে সূর্য রোজ সঙ্গে ক’রে আনে যেই ঋতু যেই তিথি যে-জীবন যেই মৃত্যুরীতি মহাইতিহাস এসে এখনও জানে নি যার মানে; সে-দিকে যেতেছে লোক গ্লানি প্রেম ক্ষয় নিত্য পদচিহ্নের মতো সঙ্গে ক’রে; নদী আর মানুষের ধাবমান ধূসর হৃদয় রাত্রি পোহা...
আকাশ ভ’রে যেন নিখিল বৃক্ষ ছেয়ে তারা জেগে আছে কূলের থেকে কূলে; মানব্জাতির দু-মুহূর্তের সময়-পরিসর অধীর অবুঝ শিশুর শব্দ তুলে চেয়ে দেখে পারাপারের ব্যাপ্ত নক্ষত্রেরা আগুন নিয়ে বিষম, তবু অক্ষত স্থির জীবনে আলোকিত। ওদের চেয়ে অনেক বেশি স্বাধীন হ’য়ে তবু মানুষ যেদিন প্রথম এই পৃথিবী পেয়েছিল সেই সকালের সাগর সূর্য অনমনীয়তা আমাদের আজ এনেছে যেই বিষম ইতিহাসে— যেখানে গ্লানি হিংসা উত্তরাধিকারের ব্যথা মানুষ ও তার পটভূমির হিসেবে গরমিল রয়েছে ব’লে কখনো পরিবর্তনীয় নয়? মানুষ তবু সময় চায় সিদ্ধকাম হ’তে: অনেক দীর্ঘ অসময়— অনেক দুঃসময়। চারিদিকে সৈন্য বণিক কর্মী সুধী নটীর মিছিল ঘোরে মুখ ফেরাবার আগে— তাদের সবের সহগামীর মতো ইতিহাসের প্রথম উৎস থেকে দেখেছি মানুষ কেবলি ব্যাহত হয়েও তবু ভবিষ্যতের চক্রবালের দিকে কোথাও সত্য আছে ভেবে চলেছে আপ্রাণ: পটভূমির থেকে নদীর রক্ত মুছে মুছে বিলীন হয় যেমন সেসব পটভূমির স্থান।
এইখানে মাইল-মাইল ঘাস ও শালিখ রৌদ্র ছাড়া আর কিছু নেই। সূর্যালোকিত হয়ে শরীর ফসল ভালোবাসি: আমারই ফসল সব,— মীন কন্যা এসে ফলালেই বৃশ্চিক কর্কট তুলা মেষ সিংহ রাশি বলয়িত হয়ে উঠে আমাকে সূর্যের মতো ঘিরে নিরবধি কাল নীলাকাশ হয়ে মিশে গেছে আমার শরীরে। এই নদী নীড় নারী কেউ নয়;— মানুষের প্রাণের ভিতরে এ-পৃথিবী তবুও তো সব। অধিক গভীরভাবে মানবজীবন ভালো হ’লে অধিক নিবিড়তরভাবে প্রকৃতিকে অনুভব করা যায়। কিছু নয় অন্তহীন ময়দান অন্ধকার রাত্রি নক্ষত্র;— তারপর কেউ তাকে না চাইতে নবীন করুণ রৌদ্রে ভোর;— অভাবে সমাজ নষ্ট না হলে মানুষ এই সবে হয়ে যেত এক তিল অধিক বিভোর।
পৃথিবীর কোলাহল সব ফুরিয়ে গেছে সেই শেষ ঘুম এসেছে নক্ষত্রের ভিড়ে এখুনি তাদের আলো নিভে যাবে পড়ে থাকবে অন্ধকার নিস্তব্ধ চরাচর পড়ে থাকতে ভালোবাসবে চিরকাল সেই হিম অন্ধকারের শান্তির ভিতর বিধাতার হাতের কাজ ফুরিয়ে যাবে সেই শেষ ঘুম এসেছে নক্ষত্রের ভিড়ে সেই শেষ ঘুম।
আমরা যদি রাতের কপাট খুলে ফেলে এই পৃথিবীর নীল সাগরের বারে প্রেমের শরীর চিনে নিতাম চারি দিকের রোদের হাহাকারে,— হাওয়ায় তুমি ভেসে যেতে দখিন দিকে— যেইখানেতে যমের দুয়ার আছে; অভিচারী বাতাসে বুক লবণ— বিলুণ্ঠিত হলে আবার আমার কাছে উতরে এসে জানিয়ে দিতে পাখিদেরও— সাদা পাখিদেরও স্খলন আছে। আমরা যদি রাতের কপাট খুলে দিতাম নীল সাগরের দিকে, বিষণ্নতার মুখের কারুকার্যে বেলা হারিয়ে যেত জ্যোতির মোজেয়িকে। দিনের উজান রোদের ঢলে যতটা দূর আকাশ দেখা যায় তোমার পালক সাদা আরও সাদা হয়ে অমেয় নীলিমায় ঐ পৃথিবীর শাটিনপরা দীর্ঘগড়ন নারীর মতো— তবুও তো এক পাখি; সকল অলাত ইতিহাসের হৃদয় ভেঙে বৃহৎ সবিতা কি! যা হয়েছে যা হতাছে সকল পরখ এইবারেতে নীল সাগরের নীড়ে গুঁড়িয়ে সূর্য নারী হ’ল, অকূলপাথার পাখির শরীরে। গভীর রৌদ্রে সীমান্তের এই ঢেউ— অতিবেল সাগর, নারি, সাদা হতে-হতে নীলাভ হয়;— প্রেমের বিসার, মহিয়সী, ঠিক এ-রকম আধা নীলের মতো, জ্যোতির মতো। মানব ইতিহাসের আধেক নিয়ন্ত্রিত পথে আমরা বিজোড়; তাই তো দুধের-বরণ-সাদা পাখির জগতে অন্ধকারের কপাট খুলে শুকতারাকে চোখে দেখার চেয়ে উড়ে গেছি সৌরকরের সিঁড়ির বহিরাশ্রয়িতা পেয়ে। অনেক নিমেষ অই পৃথিবীর কাঁটা গ...
Comments
Post a Comment