স্বর্গ-নরকের থেকে

কোনও স্বর্গ,— কোনও এক নরকের থেকে
আমি তারে ডাকিলাম কাছে
কোনও এক ডাইনীর আয়নায় হঠাৎ তাহার মুখ দেখা দিল তাই
চিনলাম— এই সেই
তোমার নিজের ঘ্রাণে আবার দাঁড়ালে তুমি কাছে
মৃগীর মুখের রূপে যেমন আবিষ্ট হয় চিতা
বনের গভীর পথে— জ্যোৎস্নায়
মুগ্ধ হ’য়ে রহিলাম

তুমি-আমি অই রূপকথার ভিতরে
এক রাত এক দিন কাটায়েছি শুধু
জীবন অক্লান্ত ছিল আমাদের সে-সময়ে
ডাইনীর আয়নায় চোখ তুলে যখনই তোমারে আমি ডাকিতাম
আমার নিকটে এসে ব’লে যেতে— ‘এই আমি, এই আমি আছি’
কোথাও অনেক দূরে চ’লে গিয়ে হঠাৎ আমার কথা মনে হ’লে
মুহূর্তে আসিতে তুমি কাছে
(ডাইনীর কার্পেটে চ’ড়ে)
সে-সময় দিনে রাতে যত বার গিয়েছি মরিয়া
সেই— সেই— পুরোনো সে-ডাইনীর ওষুধ পেয়েছ তুমি তত বার
তত বার বাঁচায়েছ
জেগে উঠে পেয়েছি দুধের ঘ্রাণ আমি
তোমার বুকের থেকে ঝরিতেছে

এই সব মনে হ’ল বসন্তের রাতের বাতাসে
পাখির বোনের নীড়ে এখন ডিমের জন্ম হবে
তাই তারা দলে-দলে আসিতেছে
মেরুর পাহাড় ছেড়ে
আফ্রিকার বন থেকে
নিষ্ফল আড়ষ্ট মাঠ-প্রান্তরের
মিছে কথা পিছে ফেলে রেখে
সমুদ্রের ফেনার ভিতর দিয়ে ভেসে
মৃত্যুর দাঁতের সঙ্গে খেলা ক’রে
উৎসাহে-সাহসে তবু
নতুন নক্ষত্রে এই,— আমাদের বসন্তের রাতে
তাদের ডিমের জন্ম দিতে

কোনও পাখি পিছে প’ড়ে নাই আজ
কেউ আজ অপেক্ষায় নাই
সকলের সময় এসেছে
প্রেমের সময়,
অনেক বিস্ময়ে আমি ভাবিলাম
তাহার অন্তরে ডিম জন্মিবে না কি!

খেতের ভিতর থেকে শস্য কেটে ল’য়ে গেছে চাষা
তবুও মাঠের ফাটলের ফাঁকে-ফাঁকে
অসংখ্য ধানের সোনা প’ড়ে আছে
সে-সবের দিকে চেয়ে আহ্লাদ কি হবে না তাহার?
নীড় বাঁধিবার সাধ হবে না কি?
নীড়ে থেকে আজ এই বসন্তের রাতে
রোমহর্ষ হবে না কি—
সে এক প্রথম ডিম রক্তে তার আসিতেছে ব’লে?

আজ আমি সে-মায়াবী নই—
ডাইনীর আয়না— সে নাই আজ
ডাইনী মরিয়া গেছে
জাদুর প্রথম কথা— শেষ কথা, ভুলে গেছি আমি সব
(সামান্য মানুষ হ’য়ে গেছি)

আমার ঘুমের চোখে সে আমারে দেখা দিল,
আমি তারে বলিলাম:
‘বাইজেনটিয়ামে— রোমে… তুমি যেন কোনও এক জানালায় ছিলে
অনেক পায়রা ল’য়ে কোনও এক অলিন্দেতে ছিলে না কি?
নীল— লাল— মসলিন পর্দা সরায়ে
অসংখ্য বিষণ্ণ বার্ড-ব্যালাডের জন্ম তুমি দিয়েছিলে না কি?
তোমার বাগানে সেই গোলাপের রঙ ছিল ননীর মতন—
লাল নয়—
তোমার মুখের রূপ গাঢ় হ’য়ে উঠেছিল তবু সব প্রেমিকের বিমর্ষ প্যাশনে’
(মনে পড়ে উজ্জয়িনী— অবন্তী— বিদিশা-)
তবুও আবার মনে পড়ে
আরও গাঢ় হ’য়ে
বাংলার পূর্ব দিকে
পদ্মার ওপারে
অনেক জলের রাতে তারাবনে— তারাবনে চলেছিলে তুমি
মানুষ ঘুমায়ে থাকে ব’লে এই পৃথিবীতে তখন জাদুর সৃষ্টি হয়
তোমার মুখের মতো রূপ শুধু জন্ম লয় সে-সময়
সেই প্রেম— সেই সাধ— সেই স্বপ্ন— আবেগের জন্ম হয়
আমরা দেখি না তাহা
হৃদয়ের অনুভূতি দিয়ে বুঝি
তবু তুমি আমারে দেখায়েছিলে সব—
দুপুরে মেঘের অন্ধকারে
ভিজে বাতাসের হাতে কেঁপে উঠে
বাজকুড়ুলের শব্দে বাদলের ভোরে
মনে পড়ে সব

আজ এই বসন্তের রাতে
সিন্ধুর উপর দিয়ে বিদেশের পাখি সব
আসিতেছে আমাদের দেশে
তাদের প্রথম ডিম জন্মিতেছে
তোমারে খুঁজেছি আমি তাই!
‘মেয়েলোক, আছো তুমি না কি?’

ঘুমের ভিতর দিয়ে তারে আমি শুনিলাম:
‘সত্য হয়ে আছি আমি’

জেগে দেখি সে দাঁড়ায়ে আছে
বলিতেছে: ‘আমি আছি-‘
আমার হতাশা— পীড়া— অবসাদ— বিহ্বলতা দেখে
বিমর্ষ সে হ’য়ে গেছে
গভীর আঘাত এক মুখে তার লেগে আছে যেন
আমার সন্দেহে— প্রশ্নে—
ডাইনীর মন্ত্র সব ঝ’রে গেছে সব দিকে
আমার মায়ার কৌটা হারায়েছি
সাহসে আশ্বাসে তবু হৃদয় ভরিয়া গেল সেই দিন
প্রেম যেন ডাইনীর আয়নার মতো
(কিম্বা তারও চেয়ে তার শক্তি বেশি)
সেই দিন মনে হ’ল
তোমারে নিকটে পেয়ে— তোমার মুখের দিকে চেয়ে
তোমার আঘ্রাণে স্বাদে বেঁচে থেকে
তোমাকে ডিমের মাতা জেনে

বসন্তের রাত সেই অন্ধকারে মিশে গেল— আহা,
পাখিরা চলিয়া গেল সমুদ্রের ওপারের বরফে— ব্লিজার্ডে—
নিস্পৃহতা খুঁজে
অনেক গোলাপি— সাদা— নীল ডিম ভেঙে প’ড়ে গেল
অনেক পাখির ছানা ম’রে গেল বিছানায়
অনেক পাখির মাতা প্রতারিত হ’য়ে গেল
অনেক পাখির পিতা বিষণ্ণ— বিমর্ষ হ’ল
হৃদয় কঠিন হ’ল দিকে-দিকে

আমি তারে বলিলাম: ‘মেয়েলোক, আছো তুমি না কি?’
ঘুমের ভিতর দিয়ে শুনিলাম: ‘আছি আমি’
কী এক শূন্যতা তবু অন্ধকারে জেগে থেকে হৃদয়েরে ধ’রে নিল
প্রশ্ন শুধু বেঁচে রইল
অশ্রান্ত সন্দেহ এক শকুনের ঠোঁটের মতন
কোথাও আমারে যেন তাড়া ক’রে আসে
কেউ এসে বাঁধা আর দেয় না ক’
যাহার পায়ের শব্দ শুনে
ম্যাগপাই সব-চেয়ে আগে উড়ে যেত
কোথায় কাহার তরে সন্তানের জন্ম দিতে গিয়েছে সে চ’লে
অনেক বিস্মিত হ’য়ে ভাবি আমি

কোন্-সে পাখির তরে তাহার পাখায় আজ বর্ণ ধরিয়াছে?
মিলনের দিন আসিয়াছে
কার সাথে তার?
কোন্ দিকে?
হাড়ের মতন সাদা গাছের ডালের ফাঁকে যেইখানে চাঁদ
সোনার ডিমের মতো ঝুলিতেছে
বিকালের আঁধারের প্রথম বাতাসে
সেই স্বপ্ন— ম্যাজিকের দেশে
রয়েছে সে—
(তাহার ভিতরে ডিম আসিতেছে— আসিতেছে— সেইখানে)

এইখানে শীতের বাতাসে
দাঁতে-দাঁতে খিল ধ’রে যায়
মুখের ভিতর থেকে কড়্-কড়্-কড়্-কড়্ শব্দ হয়
মড়ার খুলির মতো আমার নিজের মাথা না কি?
কবরের ভিতরে কি শুয়ে আছি
ভ্যাম্পায়ারের মতো?

কিছু নয়— কিছু নয়— কিছু নয়— নয়—
আমার এ মধুর হৃদয়
নরম— গভীর—
যখন আঁধারে মশা নেমে আসে গোধূলির অস্পষ্ট আকাশে
ছাগলছানার নাচ থেমেছে নদীর ধারে ঘাসে
আবার তাহারে গিয়ে প্রশ্ন করে
ভেবে লয় সে আজও আমারে ভালোবাসে
অনেক কবিতা লেখে তার নামে
তাহার হাতের লেখা সেই সব চিঠির বাতাসে
আবহাওয়া সৃষ্টি হয়
ভালোবাসা ফুলে ওঠে আকাশের নক্ষত্রের নিয়মের প্রতি
সে এক অতল সত্য আবিষ্কার করি আমি অন্ধকারে
এক জন ছোট মেয়ে এক দিন যেই সত্য তার মুখে বলেছিল
তাহার আশ্চর্য জোর লক্ষ করি
আশ্বাসে— সাহসে— প্রেমে নক্ষত্রের মতো হ’য়ে
আমি তারে বলি গিয়ে: ‘মেয়েলোক, আছো তুমি না কি?’
‘আছি আমি, আমি— আমি আছি’
স্বপ্নের ভিতর দিয়ে শোনা যায়।

Comments

সর্বাধিক পঠিত কবিতা

যত দূর চোখ যায়

তবুও সে আসবে না আর

এইখানে প্যাকাটির মতো

আকাশের চাঁদ

যাত্রী

পটভূমি

সূর্য রাত্রি নক্ষত্র

রবীন্দ্রনাথ

পটভূমির ভিতরে গিয়ে

নারীসবিতা