এ-সব শীতের দিনে
এ-সব শীতের দিনে— মাঠে-খেতে ততটা সময়
কে আর করেছে কাজ— সহজেই দিনের আলোক
মানুষের কুটিরের প্রাঙ্গণে ক্রমে নিভে আসে— নিজের গহ্বরে
জন্তুরা যাবার আগে স্পর্শাতুর কাস্তে হাতে নিয়ে
মানুষেরা ঘরে যায়— মাঝে-মাঝে দেখা যায় ফকির মুস্তফি
কিছুটা অকুতোভয় হয়ে তার বেগুনের খেতে
পরিচর্যা করে তবু— যাতে ক’রে মনে হয় স্বভাবত নিজেদের সক্রিয়তায়
ফসল ফলেছে ঢের এই বার মুস্তফি’র খেতে
ঝুড়ির ভিতরে ভ’রে এই সব সাদা নীল নীলাভ বেগুন
সবুজ বেগুনগুলো বিক্রি হবে প্রতি-দিন— প্রতি নিয়তই
যেন কোনও বেগুনের বেবিলন গ’ড়ে ওঠে ধীরে
অসুৰ্বানিপাল আসে— ক্রীতদাসীদের
কলরবে ভ’রে ওঠে জ্যোৎস্নায় শীতের কুয়াশা
নিশিত রৌদ্রের দিনে— ধীরে— তার পর
বাগান নিস্তেজ হয়ে আপনার ভিতরের হাড়
বার করে বিকেলের রৌদ্রে আলোকিত অলৌকিক মনে হয়।
এমন কেটেছে তার সোরগোলে— দুঃসময়— সমস্ত শীতের দিনগুলো
তিরিশ বছর ধ’রে— বাংলার পাললিক মাটির প্রতিভা
এসেছে বন্ধুর মতো অন্ধকারে— মানুষের হৃদয়ের জ্ঞান
এর চেয়ে বেশি কিছু চায় নাই— শতাব্দীর বড়ো পৃথিবীর
দুরূহ মনীষা গেছে মুস্তফি’র মাথার উপরে
কিমাকার ক্রূর বাতাসের মতো অন্ধকারে ভেসে
নিজের নির্দেশ নিয়ে— প্রলাপের মতো ব’কে মুস্তফি’র বৌ
অবশেষে এক দিন এ-রকম স্বার্থহীন মাটির ভিতরে
কখন গিয়েছে ঢুকে— সন্তানেরা একে-একে সব
তেমনই আতুর হয়ে এই সব অকৃত্রিম দৃশ্যের ভিতরে
মাটির নমুনা আজ— উলুখড়— উইঢিবি— খাঁড়ি— ফাঁদলের
বিশুষ্ক নদীর— সব বিভিন্নতা— মাঝে-মাঝে মাটির চেয়েও
অধিক নিস্তব্ধ হয়ে থাকে সব— যত তারা অতীব আগ্রহে
ব’লে যেতে চায় সব। মিয়োনো লণ্ঠন নিয়ে মুস্তফি তবুও
শীতের প্রথম রাতে আজ কিছু অধিক সচ্ছল
দু’-একটা বই পড়ে— অন্য কোনও উপচিত স্থবিরের সাথে
মুলো, আলু, অন্ধকার, ইঁদুরের বিবরণ পরিধি নির্যাস
গল্পের ভিতরে টেনে নিঃশেষিত ক’রে ফেলে, ম্লান লণ্ঠনের
মুখোমুখি ব’সে থেকে— একাকী মানুষ ব’লে টাকার গরমে।
জাপানি লণ্ঠন আজ কিনেছে সে— কিছু কেরোসিন
অনেক গুবরে, কীট, সুদর্শন, দেয়ালি পোকার
অন্তরঙ্গ ওড়াউড়ি, নিজের ধবল দাড়ি, চোখ, ঠোঁট, নাকের বিবরে
এই সব পেয়েছে সে— ভালোবাসে— আপনার প্রয়োজনে ল্যাম্প
সহজেই নিভে যায় এক বার— শেষ বার— বেগুনের খেতে
নিজেকে ফুরায়ে এনে— তিত্তিরাজ-গাছে
পেঁচা’কে পাহারা দিতে ব’লে গিয়ে আলোড়িত জন্তুর মতন
নিজের বিবরে ঢুকে মুস্তফি’ও আমাদের সকলের সাথে
দশ বাঁও জল থেকে কেবলই ধোঁয়াটে সূর্যালোকে—
সূর্যালোক এক দিন মুস্তফি’র কল্পপৃথিবীতে
ছিল ব’লে— নেই থাক— না জেনেই শেষ-দিন তার সমভাব
পারিষদ, সৈন্য, ভাঁড়, গণিকা ও সম্রাটের ভিড়ে পৃথিবীতে
না ম’রে সমস্ত হয়ে মরণের ভিতরে জীবনে।
Comments
Post a Comment