কত দিন থেকে

কত দিন থেকে
এই শীর্ণ মঠটুকু আসিতেছি দেখে
এর নীচে কে-বা আছে করি নাই খোঁজ
অপরাহ্নে আজ
শুনেছি বাতাস যেন সুস্পষ্ট সহজ
‘আমি আছি— শুনে যাও-‘, আমারে সে কাছে তার নিয়ে গেল ডেকে

‘আমারে চেন না তুমি বুঝি?’
কাঁকনমালা যে আমি— এক-শো বছর আগে ম’রে গেছি— সেই রূপ আজ তুমি খুঁজি
পৃথিবীর পথে গিয়ে পাবে না ক’ আর
বহু দিন প’ড়ে আছি মঠের ফাটলে
এখানে বিষম অন্ধকার
নিশিন্দে-পাতার গন্ধ— আকন্দ-বাসক-লতা— এক-শো বছর ধ’রে এইখানে আছি চোখ বুজি

‘ইছামতী কত দূর গেছে স’রে?
শুনি না তো শব্দ তার— ইছামতী গেল না-কি ম’রে?
আমার সে-ইছামতী মাঘীপূর্ণিমার-‘

এত বলি নিঃশ্বসিল
কোনও কথা বলিল না আর
দাঁড়ায়ে ছিলাম আমি বহু ক্ষণ— মনে হল রূপসির কাঁকনের মতো শব্দ ক’রে
কোনও কথা বলিবে না কেউ কি আবার?
‘তুমি আছ?’ ‘আছি আমি, মঠের ফাটলে এই ঘুম পেয়ে গেছিল আমার-‘
বলিল সে: ‘জানো না কি ফোঁপরা এই মঠের ভিতরে
কারা আছে?’
বলিলাম বহু ক্ষণ পরে:
‘তুমি আছ— অন্য-কেউ আছে না-কি আর?’
কাঁকন উঠিল হেসে— চেয়ে দেখি অঘ্রানের হিম জ্যোৎস্নায়
দিগন্ত গিয়েছে ভ’রে, হায়
‘যারে পারো শুধাও গে এ কাহার মঠ-‘
‘তোমারই তো-‘
মর্মরিল অঘ্রানের কুয়াশার বট:
‘এই মঠ: এ-মঠের নীচে রাজা রামনাথ রায়-‘

‘সে কী কথা? এ-মঠ কি পুরুষের?— রাজা-রাজড়ার?’
অঘ্রানের বট তবু কোনও কথা কহিল না আর
দাঁড়ালাম বহু ক্ষণ— তবু তার পর
মঠের ভিতর থেকে
নাই কোনও স্বর
এক-শো বছর যেন এক পলে হয়েছে উজাড়…

রূপসির কাঁকনের মতো কার গলা
বলিল আবার ফের, ‘আছ তুমি?’ ‘আছি আমি-‘ ‘এত ক্ষণ সাতাশ মহলা
এলাম অনেক ঘুরে— দেরি ঢের হয়ে গেল তাই
রামনাথ রায় আর তার সব রূপসিরা এই মঠে আছে
কেবল কাঁকনমালা নাই-‘
বলিল বিশাল বট: ‘শেষ হল সব কথা বলা?’

কহিল কাঁকনমালা: ‘শেষ হয় নাই
আমি শুধু মঠ ছেড়ে উঠে যেতে চাই
বকের ডানার গন্ধ-মাখা কত সন্ধ্যায়— কত জ্যোৎস্নায়
আমারে দিগন্ত থেকে ডেকে আনে
রামনাথ রায়
ইচ্ছা হয় ইছামতীটির পাড়ে ঐ ভাঁট-বনে অঘোরে ঘুমাই—
কিম্বা ইচ্ছা হয়
কোলাহলে যে-পৃথিবী আজও জেগে রয়
যেই সব রূপসিরা আজ বেঁচে আছে
তাদের ভিতরে ভিড়ে
চ’লে যাই কালিন্দীর কাছে
বৈতরণী-নদীটিরে করি কী-যে ভয়!’

মর্মরিল সেই বৃদ্ধ বট:
‘শোনো না কি, রামনাথ— শোনো না কি, মঠ?—
যার লাগি ত্যাগ করেছিলে তুমি সাতাশ রূপসি
তোমার কাঁকন সেই
দাঁতে দাঁত ঘষি
ঘুণ-ধরা হাড়ে আজও সাজিতেছে শঠ!’

অবশেষে রামনাথ রায়
নিঃশ্বসি বলিল চুপে: ‘কী-বা করা যায়
যত দিন পৃথিবীতে আছিলাম— সৌন্দর্যের গভীর আঘাত
প্রেমেরে পাখির মতো ছিঁড়ে ফেলে দেখিয়াছি
প্রেম কিছু নয় যেন পৃথিবীতে— ভাবিলাম মরণের রাত
শান্ত— নীল বৈতরণী— প্রেমেরে হৃদয়ে ধ’রে অঘোরে ঘুমায়-‘

থেমে গেল রামনাথ— বলিলাম, ‘কোথায় কাঁকন?’
‘রূপবান যুবা তুমি! চলো গিয়ে যৌবনের বন
আমরা খুঁজিয়া লই পৃথিবীর পথে-‘
বলিল সে
তার পর চ’লে গেল হয়তো-বা কোনও দূর রূপের জগতে—
ছিন্ন প্রেম প’ড়ে র’ল: বৈতরণী-তরঙ্গেও শুনিলাম প্রেমের ক্রন্দন!

Comments

সর্বাধিক পঠিত কবিতা

যত দূর চোখ যায়

তবুও সে আসবে না আর

এইখানে প্যাকাটির মতো

আকাশের চাঁদ

যাত্রী

পটভূমি

সূর্য রাত্রি নক্ষত্র

রবীন্দ্রনাথ

পটভূমির ভিতরে গিয়ে

নারীসবিতা