আবার হেমন্ত-রাত

আবার হেমন্ত-রাত মানুষকে দেখে যায় কিছুটা স্থবির
কোনও এক টেবিলের পাশে ব’সে আছে
কোনও এক ভারতীয় সুধী তার কবরের থেকে উঠে এসে
তবুও কবর তার আত্মাকে পাছে
ফেলে রেখে মিশে যায় অন্ধকারে হেঁয়ালির মতো
তাই-সে পেঁচা’র রূপ ধ’রে
আদিম কারণ খুঁজে গোল পরিধির মতো ঘোরে
ক্রমশই ভালো লেগে যায় ব’লে স্বভাববশত
ঘুরে গিয়ে কবর ও ইঁদুরের দিকে চেয়ে ফাট-ধরা কর্নিসে ব’সে থাকে হিম
মৃত সব ইতিহাস— নিসর্গের উপরে ছড়ায়ে দিয়ে পালকের নরম জাজিম।

আমাদের পৃথিবীতে— এক দিন যা সব হয়েছে
সে-সবের নোঙর পড়েছে বটে— তবু তার হাল
ধ’রে আছে কর্ণধার (বিজড়িত হয়ে থেকে) স্বাতী লুব্ধকের নিচে এসে
এই ভেবে ইতস্তত মৃতের কপাল
মাঠের ভিতরে ন’ড়ে শশব্যস্ত হয়
নিকটে কমলসিড়ি নদীটির জল—
যা জোয়ারে হেজে গেছে তাদের মতন আখখুটে
প্রথমে যে-মৃত এল— আধো-পরিচিত ভেবে তাকে
তবুও অবজ্ঞা ক’রে ভালো ক’রে চিনে নিতে হবে না কি
কোথাও টেবিলে তার বহুতর বিচ্ছিন্ন কাগজ
নেড়ে সে শাসন ক’রে যেতেছিল সমাজের শৌখিন চালাকি
তবু তার জীবনের দর্শনের টানে
সমগ্রতার কোনও সৎ পরিচয়
সে-দিনও পাই নি তবু আজ মনে হয়
হয়তো তা লেখকের পোড়নের প্রাণে
সে এক পৃথিবী, জন্তু, সমাজ, সুবিধা, ভাঁড়, রমণীকে চিনে
তবুও ঘুসের বিনিময়ে সব মুক্ত ক’রে দিয়েছে জামিনে
না হলে কী ক’রে সূতি ফরাসডাঙা’র খাপি ধুতি
ঠিক কোথায় লুকায়ে রয়ে গেছে।
ডোরাকাটা বিড়াল কাছে ছিল
যদি না তাড়িয়ে নিয়ে থাকে,
রয়েছে হরিতীকৃত শুক কিংবা বিষম আঁতেল
সাদামাটা অন্য-রূপ জমিতে দাঁড়ায়ে

বই তার বিক্রি হয়েছিল, তাই
হয়তো দু’-একখানা আমার টেবিলে
রয়ে গেছে পুরাতন জননীর মতো
অথবা ধাত্রীর মতো— মনে ক’রে নিলে সকলেরই আবহাওয়া-মতন।
অথবা মায়ের মতো— কেননা এ-পৃথিবীর পুরাতন রস
বিশেষত টিনের সঞ্চয়
ঢের দিন বেঁচে থেকে কৃমিকীট লিপ্ত হয়ে রয়
বেড়ে যায় দীক্ষিতের কাছে সেই ম্লান পনিরের হাতযশ
তার সাথে শেষ বার দেখা হয়েছিল এক দ্রুত জনমানবের ভিড়ে
তবুও সে দ্রুততর। এখন থেমেছে কোনও তীরে
পিষ্ট হয়ে। ভেবে সে তাকাতে-তাকাতে নিভে গেল বিম্বের মতন।
গম যব পিষে যায় জাঁতা
ততই দ্বিগুণ বেগে ঘুরে যায় ব’লে
তেমনই উৎকর্ষে বিলোড়িত হয় চেয়ারম্যানের ঘাড় মাথা।
সবিশেষ চুপ থেকে চেয়ে দেখি নদীটির জলের ভিতরে
সে ও তার ক্লান্ত প্লাম্বার
এখন জলের রং মৃতদের চেয়ে স্বচ্ছ ব’লে
দুই কানে মাখায়েছে কালো বিড়ালের অন্ধকার
অথবা বায়ুর চেয়ে কঠ উপনিষদের চেয়ে জল
সহসা অধিক ভারি হয়ে গেলে সাদা বিড়ালের মতো নির্মল

তাহাদের দু’ জনকে দেখা যায়
সে ও তার মৃত আত্মাকে
(তাহাদের দু’ জনার মাঝখানে ঢের শ্রেণি রয়ে গিয়েছিল)
এখন আবার ভোট নিলে তবু এই লোকটার
(পুনরায়) জিৎ হয়— আমাদের নগরীর পথে যেই মরামাস— মুলো— ইঁদুর
মানুষের হৃদয়কে ক’রে রাখে জাম
সে-সব গোলায়ে নিজ পিতার প্রণাম
কেউ যদি পায় তবে তাহার ঠ্যাঙের নিচে খুর
বার হয়ে পুনরায় কপালের ‘পরে দেখা দিয়ে যাবে শিং
জেনে সে চালায়ে নেয় তবুও তো অম্লান কমিটি-মিটিং।

কোনও মৃত আজ পুং-মৌমাছি’র ঢের পিটুনির মাঝে আছে মেঠো রাত্রির ভিতরে
সহসা দিল না দেখা— পূর্বাচার্যদের কাছ থেকে
পৃথিবীতে শিক্ষা তারা পেয়েছিল অনেক রকম
এখনও বিশদ তাপ পেতেছে অনেকে
তবুও নীরেন সেন তেরো-শো পঁচিশ সালে তার সাথে দেখা
ইরানি দোকানে এক— বোম্বাইয়ের— সেই শেষ বার
মানুষটা বরাবর আওতার বার
মনে ক’রে নিয়েছিল যে-রকম দু’ দিকের জল মিশে গিয়ে
এক জল হয়ে থাকে নদীর ভিতর
তেমনই সে— আর তার বোম্বাইয়ের লিলি দেউস্কর।

নীরেন অনেক দিন চ’লে গেছে আমাদের পৃথিবীর থেকে
তারও আগে বাংলা’র পরিধিকে ছেড়ে
তবু তার ঢের দিন আগে যেন মনে হয় আমরা দু’ জন
কথার ফিকিরে প’ড়ে— অবশেষে পরস্পরের দিকে তেড়ে
যেতাম গভীর রাতে পরিত্যক্ত সরকিট-হৌসের ভিতরে।
সেইখানে অন্য কেউ নেই
তবুও দুইটি প্রাণী— শুরুতেই বিতর্কের খই ফোটাতেই
সহসা মাঠের থেকে (মুখ্যত) হুবহু একটি গাধা ঘরে
ঢুকে যেত— অনুকূল বায়ু পেয়ে— এমনই গভীর তার নেশা
হাতে-হাতে চাঁদ পেয়ে যেত তার স্বর্গীয় হ্রেষা।

বহু দিন থেকে চারি-দিকে মত্ত সেই গড্ডলিকার গাধা অবিকল দেখে মনে হয়
কোথায়-বা সেই গাধা আজ
অথবা সে-রাসভের বয়স্ক, প্রবীণ
মালিক— মথুর ধোপা— মানুষের ছাড়া-কাপড়ের লাখেরাজ
যখন বিলেতি মদ ধরেছিল— গাধাও ঘুড়ি’র দিকে সবে এক দিন—
অথবা নীরেন গেল গন্ধর্বীর পিছে—
বক্তা— লেখক— চাঁই— মঙ্গলের কাজ ছেড়ে দিয়ে।
আমরা সবুজ ঘাস পাই যদি পাইকারি টাট্টু ডিঙিয়ে
তা হলে নীরেনই ঠিক— আমি আজ ভয়াবহ ভাবে মিছে।
যাবার আর-এক যুগ কাঁচিয়ে নেমেছে ব’লে (সেই যুগ): সে-যুগ এখন পাকাপাকি।
এখন নীরেন আর দেউস্কর— দু’ জনে একটি প্রেত না কি?

Comments

সর্বাধিক পঠিত কবিতা

যত দূর চোখ যায়

তবুও সে আসবে না আর

এইখানে প্যাকাটির মতো

আকাশের চাঁদ

যাত্রী

পটভূমি

সূর্য রাত্রি নক্ষত্র

রবীন্দ্রনাথ

পটভূমির ভিতরে গিয়ে

নারীসবিতা