নিষ্ক্রিয় আলোয় আমি

নিষ্ক্রিয় আলোয় আমি চমকিত করিলাম এক জন কিষানকে
বাংলা’র;— অন্যেরাও রয়ে গেছে নিকটেই
তাদের অ্যানাক্রনিস্টিক শব্দ শোনা যায় কালো, কিমাকার
মাটির উপরে ধীরে— যেন কোনও প্রস্তর-যুগের
বিশিষ্ট শব্দের মতো— ধ্বনির জননীদের প্রতারিত ক’রে
নিঃসহায় প্রতিধ্বনিদের মতো আজ এত দিন পরে
শতাব্দীর প্রত্যন্ত সীমায় এসে কেমন নির্জন অবসোলেট
মানুষের কাজে তবু চির-দিন সম্ভ্রম রয়েছে।
মৃত্তিকা সে-কথা জানে হয়তো-বা
যখন সে অপরের শ্রান্তির অপেক্ষা ক’রে চুপে
চেয়ে থাকে— মুলো— ঢিল— ইঁদুরের গর্ত— মৃত দেহ
দিয়ে যায়— সহসা আকাশ থেকে নেমে এসে মেঘের মতন এক জীব
হেমন্তের অত্যল্প আলোয় তার ভূখণ্ডের কাছে
নীরবে দাঁড়ায়ে আছে ব’লে সেই চাষা
কোদালের ব্যবহার থেকে চুপে— ধীরে জেগে বিকশিত হয়ে
অর্থগুণ পেতে গেল— তবুও তাহার মুখ আজ
গুণময় নয় কিছু— নিসর্গের আলোকের রঙ থেকে চুরি ক’রে আমি
যে-সব প্রতিভা এনে জড়ো ক’রে রেখেছি হৃদয়ে
কলমের ব্যবহারে, আমার ভাষায়, মুখে, শারীরিকতায়
সেই সব তার কাছে বাতাসের শব্দের মতন;
সর্বদাই কানে সে তা অনুভব ক’রে গেছে ব’লে
কান শুধু স্পর্শাতুর— অপ্রসন্ন আঁধার গুদামে
হেয় ইঁদুরের মতো— হৃদয় কাহারও কিছু নয়।

তবুও নিসর্গ— এক দিন— কোনও স্বপ্ন দেখেছিল
মানুষকে লেজ থেকে মুক্ত ক’রে নীলিমার নিচে
মাটির উপরে এনে সসম্ভ্রমে উপনীত ক’রে দিয়ে যাবে
অনেক শতাব্দী তবু কেটে গেছে— অন্য সব অপ্রগলভ নক্ষত্রের সাথে
সে এখন নিজ-মনে কাজ করে— মানুষের লেজুড় খসায়ে
কোদালের ‘পরে তাকে রেখে গেছে— রেখেছিল কি-না
সেই সব কথা আজ নিসর্গের ক্রিয়াবান হৃদয়ের থেকে
মুছে গেছে— সূর্যের সোনালি রশ্মি এনে
যেন সে ভোরবেলা সন্তানের মাথার উপরে
ঢেলে দেয়— (স্নিগ্ধ রুটিনের মতো সর্বদাই সময়ের দিকে
সুশৃঙ্খল দৃষ্টি রেখে)— তবুও বিবর্ণ সেই চুলের ভিতরে
এখনও নিরীহ শিং রয়ে গেছে— কেন আছে— কী ক’রে রয়েছে
কার্তিকের আলোকের সোনা— জল— মেঘের প্রতিভা
অথবা শস্যের স্বর্ণ সন্তানের কাছে তার আজও
আগাম জিনিস— শুল্ক— মানে না সে— বহুতর শতাব্দীর পিছে
এখনও গফুর একা প’ড়ে আছে— আপনার জন্তুর মতন
এই সব অনুভব— আজ এই হেমন্তের বিগুণাবতার
প্রকৃতির তরে নয়— কেননা উজ্জ্বল তার অন্য সন্তানেরা
ঢের আগে উপরের নগরীর আলোর ভিতরে
চ’লে গেছে— সেইখানে পতঞ্জলি ছিল এক দিন
মেধাবী দিনের মানে অনুভব ক’রে নিয়ে ধীরে
আমাদের দিয়ে গেছে— জরাথুস্ট্র মানুষের ভাষার ভিতরে
অন্তঃসার হয়ে ছিল— অথবা নীটশে ছিল— মার্কস
নিজ-নিজ অর্থগুণে অবতারণার মতো এসে
অনুভব ক’রে গেছে— সেই সব অনুভূতি অগণ্য মানুষ
নিজেদের পরিমিত মাশুলের বিনিময়ে কিনে
উপভোগ ক’রে গেছে জীবনের ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র অর্থময়তাকে।

এখানে গফুর তবু হেমন্তের বিকেলবেলায়
একটি দুরূহ প্রশ্ন নিসর্গের মাথার ভিতরে;
যদি সে তা অনুভব ক’রে নিয়ে আজ পুনরায়
সময়ের ভুল কাঁটা নীরবে ঘুরায়ে নিয়ে সূচনার দিকে
নিয়ে যায়— সমধিক ধীতি দিয়ে মানুষকে আর-এক বার
গড়ে যদি— তবুও সে নিজের নিয়মে ক্রমে চ’লে
আমাদের এই-সেই ইশারার অপূর্ব ব্যালটে
ভোটের মতন নয়— নিজগুণময়তায় জেগে আমি
সর্বদাই কৃষকের চেয়ে বেশি অর্থগভীর
এই উপরোধ নিয়ে বিকেলের আলোকের পথে
অনেক ঘুরেছি আমি— তবুও এখন প্রান্তর
ক্রমেই সুদীর্ঘতর হয়ে ওঠে— এই সব সুকঠিন বীট’এ
দেহ যদি বামনের মতো ক্লেশে অগ্রসর হল
তবুও হৃদয় তার নিজের বিশেষ প্রতিশ্রুতি
ক্রমশই লুপ্ত হয়ে যেতে দেখে— আধ-ঘণ্টা-টাক
এই সব কৃষাণের অন্ধকার কোদালের সাথে
আমাদের আপামর জ্ঞান যদি সমুজ্জ্বল সমতাল রেখে
ওঠে-পড়ে— তা হলে জগৎ ঘুরে আসা যেত লঘু দোয়েলের
পিঠের উপরে চ’ড়ে— কোনও এক শান্তিময় অবতার এসে
আজ এই হেমন্তের বিকেলের স্তব্ধতাকে যদি
তাকিয়ার মতো ভেবে নিজের সামগ্রীময় পিঠে
তুলে নেয়— তবে সে ঘুমাতে পারে নির্মল শিশুর মতো হেসে
চাষিরা ঘুমাতে পারে— তবু এই গোল পৃথিবীর
বয়ঃক্রম ক্রমশই বেড়ে যায় ব’লে এই হেমন্তের রাত
সাধু, শিশুদের প্রাণে ঘুম, হিম, মৃত্যুর মুখোশ
টেনে এনে আমাদের মুখোশেরও ব্যবহার দেয় না ক’
সর্বদাই এক থেকে অন্য অনুধাবনার পথে
বিতাড়িত হয়ে গিয়ে তবুও সহিষ্ণু হয়ে যারা
হৃদয়কে স্থিরতর ক’রে নিতে চায় এই অতীব অন্ত্যজ
শতাব্দীর পথে এসে— নিসর্গের রঙে মুগ্ধ হয়ে এই প্রান্তরের পথে
তাহাদের বীট আজ চাষিদের (এই সব) নিজের জিনিস
কেড়ে নিতে গিয়ে এক সমূহ সম্ভ্রম
অনুভব ক’রে নিয়ে— ফিরে যায়— থেমে থাকে— কান পেতে থেকে
কোদালের ম্লান শব্দ— আপনারও হৃদয়ের— শুনে যায় কীর্ণ কুয়াশায়
এই সব প্রত্যাখ্যাত ধ্বনি তবু এক দিন নিজের নিয়মে
অধিক নিস্তেজ হয়ে অবশেষে আমাদের এই ক্লান্ত মাঠ
এই শূন্য সময়ের সব শেষ অবসন্ন জীবনকে তুলে
গ্রাস ক’রে চ’লে যাবে। এই সব নিরুত্তর কৃষকের মুখ
যতই অধিক হিম, অকৃত্রিম হয়ে যায় তত অনুরূপ সততায়।

Comments

সর্বাধিক পঠিত কবিতা

যত দূর চোখ যায়

তবুও সে আসবে না আর

এইখানে প্যাকাটির মতো

আকাশের চাঁদ

যাত্রী

পটভূমি

সূর্য রাত্রি নক্ষত্র

রবীন্দ্রনাথ

পটভূমির ভিতরে গিয়ে

নারীসবিতা