কার্তিকের কুয়াশায়
কার্তিকের কুয়াশায় ভোরবেলা মর্মরিয়া উঠিল সে-বট
পাশে নদী— নদীর জলের বুকে ভাঙা এক মঠ
ছায়া ফেলে
যত দূর চোখ যায় ছড়ায়ে রয়েছে ক্লান্ত ধুলুটিয়া গ্রাম।
ধুলুটিয়া?— অথবা গ্রামের আমি নাহি জানি নাম
এক বার নৌকা হ’তে বিস্তৃত সে-প্রান্তরের পাশে নামিলাম
অজস্র নীলাভ পাতা লাল-লাল ফলে বট রহিয়াছে ভ’রে
শুষ্ক পাতা রক্তফল থেকে-থেকে পড়িতেছে ঝ’রে
বনের ভিতরে… ঘাসে
চারখানা গ্রাম থেকে আসিয়াছে অগণ্য শালিখ দাঁড়কাক
বাতাসের ফাঁকে-ফাঁকে শোনা যায় ঘুঘুদেরও ডাক
নরম সকালবেলা এইখানে মানুষেরে করে যে অবাক!
বলিলাম: ‘কত দিন আছ এইখানে
বট তুমি: নীললোহিতের মতো অমৃতের ঘ্রাণে’
অমৃতের ঘ্রাণে?—
কুয়াশা যেতেছে কেটে— সোনালি রোদের হাতে ঢালু পৃথিবীর
ধানি-শাড়ি চোখে পড়ে,— ময়জানি নদীটির খাড়া ভাঙা তীর
চোখে পড়ে,— চোখে পড়ে ঘাসের শরীর।
শিহরি শিশির-জল ঝেড়ে নিল বট এক বার
বহু ক্ষণ কোনও কথা বলিল না আর।
তার পর বাতাসে গুঞ্জন
শোনা গেল… কোকিলের ডাক নয়— দাঁড়কাক হয়েছে নীরব
এ যেন কেমন শব্দ
শুনি নাই বহু দিন— শুনিলাম বটের সে অভিনব রব:
‘তিন-শো বছর আমি রয়েছি এখানে
মাটি ঘাস পৃথিবীর ঘ্রাণে
পাখপাখালির মোহে
মানুষনারীর মুখ দেখে-দেখে… দেখি, রূপ নষ্ট হয়, শূন্য হয় ঘর
ধূম্র শকুনের ডাকে কেঁদে ওঠে মরালীর চর
বাতাস ফোঁপায় সাদা বিধবার মতো এসে কত বার বুকের ভিতর।’
‘ঐ যে দেখিছ নদী— ময়জানি— কত দূর স’রে গেছে আজ
শ্মশান-শ্যামার মতো এক দিন ছিল তার সাজ
আমার অসংখ্য নীল পল্লবের তলে
জানি না কী মনে হল— কী ভাবিল ও যে
এক দিন ধানখেত ছেড়ে দিয়ে শিঙের মতন বাঁকা চাঁদটির খোঁজে
অঘ্রানের কুয়াশায় ডুব দিল মায়াহীন রূপসির মতন সহজে’
‘আর কি আসিবে ফিরে— আসিবে না আর
সন্ধ্যার আঁধারে দাঁড়কাক কত বার
নদীর নরম গন্ধ পাখনায় মেখে
এসেছে আমার বুকে,— সকালের কুয়াশায় কত বার মাছরাঙা দেখি
নদীর দু’ ধার ঘিরে উড়ে-উড়ে বলিয়াছে, “ও রে বুড়ো ঢেঁকি
ঘরে আর যাবি না রে?”— তবুও আসে না আর— হয় না ক’ মুখ-দেখাদেখি’
‘সে-বার কার্তিকে এক গাঙচিল এসে
ব’লে গেছে: “নদীর প্রাণের কথা গিয়েছে যে ফেঁসে— ”
যাক… সেই সব শুনে কাজ নাই
গাঙচিল যা বলেছে, কাজ নাই শুনে
যত দিন কিশোরী রূপসি ছিল— কাছে ছিল— বিচ্ছৃঙ্খল হয়ে গেছে যৌবনের অদ্ভুত আগুনে
ম’রে গেছে তার পর— গাঙচিল যা বলেছে, কাজ নাই শুনে— ‘
‘বিচ্ছেদের ব্যথা তবে তোমারেও আঘাত করেছে বুঝি, বট?’
বহু ক্ষণ কোনও কথা কহিল না— চেয়ে দেখিলাম ভগ্ন ম্লান এক মঠ
এক-একখানা ক’রে ইট
খসাতেছে;— জল তারে লালসায় করিতেছে গ্রাস
মনিয়া-কোরা’র কান্নায় ভরিছে বাতাস
হলুদ ধানের শব্দে পথ ভেঙে দুপুর-রৌদ্রের দিকে চলিতেছে কার্তিকের মাস—
বাতাসে উঠিল কেঁপে জট
বলিল সে-বট:
‘ধুলুটিয়া গ্রাম অই
পঙ্গপাল এসে যেন খেয়ে গেছে ধান ছোলা যব
দুপুরে দেখায় যেন ডাকিনীর বনে পদ্মবাসিনী’র শব…
নাই আর উৎসাহ— উৎসব— ‘
‘আমার ছায়ার নিচে বারোয়ারিতলা গেছে ভেঙে
লাল-লাল বটফলে ঘাস আছে রেঙে
ঘাস আছে রেঙে শুধু
ঘাস আছে রেঙে আজ— পাড়াগাঁ’র সেই সব ভাঁড় আর নাই
লাল পশমের মতো নরম ফলের নিচে প’ড়ে আছে তাহাদের ছাই
কত রাতে তাহাদের ডাকি আমি— লক্ষ্মীপেঁচা’র কাছে বেদনা জানাই’
‘কিম্বা ঐ ইসকুলের ঘর
মনে হয় কোলাহল ক’রে গেছে যেন কত হাজার বছর
তার পর থেমে গেছে
অজস্র কিশোর কত আশ্বিন-ভোরের মতো মুখ
তোতাপাখিদের মতো কলরব তাহাদের— সুন্দরীর মতন চিবুক
আজ তারা কই সব? বাতাসে কীসের ঝাড়ফুঁক?’
‘নীল হয়ে ওঠে পাতা কত বার— রেশমের মতো লাল ফল
আকাশের রুক্ষ রৌদ্রে ব্যথা পেয়ে কত বার হতেছে সজল
কত গান গল্প আছে বুকে
জ্যোৎস্না-রাতে বিহঙ্গম-বিহঙ্গমা এসে শুনে যায়
তবু সেই কিশোরেরা আসে না ক’, হায়
শুকনো পাতার ‘পরে খঞ্জনাই সারা-দিন একাকী খোঁড়ায়’
‘আর রাঙা সন্ধ্যাবেলা সেই সব মেয়েদের দল
কুড়াতে আসিত বটফল
কুড়াতে আসিত শুকনো পাতা
সেই সব আইবুড়ো গ্রামের-কিশোরী
নরম আঁচলে ক’রে লাল ফল কত বার নিয়ে গেছে ভরি
পরির মতন ব’সে সারা-ভোর— দু’পহর— আমার ছায়ার নিচে খেলে গেছে কড়ি’
‘পরির মতন গেছে ঘুরে-ঘুরে নেচে
কার্তিকের রোদ থেকে বেঁচে
এসেছে ছায়ার নিচে চ’লে
গরম ননির মতো মুখ তুলে ক’রে গেছে কত কোলাহল
তাহাদেরই লাগি শুধু লাল হয়ে উঠেছিল ফল
ঝরেছিল তাহাদের ঠোঁটে বুকে মুখে অবিরল— ‘
‘তবু তারা রাতারাতি বড় হয়ে গেল সব— গ্রামের বিষণ্ন সাদা ধূলিপথ ধ’রে
কত দিন দেখিয়াছি চ’লে যায় একে-একে পালকিতে চ’ড়ে
দূর— দূর— বিদেশের দিকে
কেন তারা এত বড় হয়ে গেল— এমন বিমর্ষ হল তাহাদের মন
গ্রাম মাঠ বট ছেড়ে শহরের খোপে-খোপে হারাল এখন
জীবন এমনই রুক্ষ: নীল পাতা লাল ফুলে মেটে কি তাহার প্রয়োজন!’
‘ধুলুটিয়া গ্রাম থেকে মাঝে-মাঝে দু’-চারটি গাঁজাখোর আসে
দু’-চারটি নাঙ্গা ব্যোম সন্ন্যাসীই আজ এই বটের ছায়ারে ভালোবাসে— ‘
মর্মরিল বট
‘নদীও গিয়েছে ঢের দূরে স’রে— গ্রামের বধূরা এই পথে তাই আর
আসে না ক’; দেখি না সন্ধ্যার পথে কামরাঙা-লাল কস্তাপাড়
সারা-দিনমান জেগে দেখি না ক’ মুখ আর শঙ্খমালা-চন্দ্ৰমালা-মানিকমালার’
‘নাই তারা আর
তিন-শো বছর আগে ঝ’রে গেছে— আমারও চোখের কোণে আসে অন্ধকার
সন্ধ্যার দাঁড়কাক বক শঙ্খচিল
খুঁজে নাও অন্য কোনও বট, কোনও অশ্বত্থের নীড়
কর্ণফুলী ধলেশ্বরী ভৈরবের তীর
খুঁজে নাও— ময়জানি নদীটির পাশে ফুরাতেছে এ-জীবন তিন শতাব্দীর।’
Comments
Post a Comment