এই ঘর অবিকল
এই ঘর অবিকল পারম্পর্য বুকে লয়ে— তবু
স্তব্ধ হয়ে পড়েছিল সারা-দিন আজ
তার পর রাত্রি এল হেমন্তের নিস্তব্ধতা নিয়ে
আমিও এলাম চ’লে— ধূলিধূসরিত কোনও মিউজিয়মের
দারোয়ান যখন লাগাবে তালা— ক্লিক শব্দ হয়
অথবা হবার আগে যখন পিছল তালা ন’ড়ে ওঠে
শিশিরে উজ্জ্বল কোনও অমায়িক পাখির মতন
আমি আসি; আমাকে আসিতে হয় রোজ
টালিগঞ্জ থেকে ট্রাম— অথবা ট্রামের
রাঙা— নীল— আলো— ইপ্সা— রাত এগারোটা এলে শহরের
নিরুত্তর— নিবিড়— বিদেশি মুখ
প’ড়ে-পাওয়া পথগুলো— খড়ির সাক্ষরহীন
সুদীর্ঘ জানালা সব— কোনও ক্রুশচিহ্নহীন
নিরুদ্ধ দরজাগুলো— অন্ধকার গলি— অননুমেয়র মতো
গ্যাসের স্বর্গীয় আলো— অননুভূতের মতো
আমাকে তোমার দিকে ডাকে।
প্রায়ই দেখা হয়— তবু— মনে হয়
বহু দিন ম’রে ছিলে তুমি
এই দেশ থেকে দূরে— উত্তর-পশ্চিম দিকে
যেইখানে জুতো-আঁটা পায়ের মতন নেমে— ভূমধ্যসাগরে
কোনও এক দেশ ছিল হয়তো-বা— আজও রাত্রে ল্যাম্পের কাছে
ভৌগোলিক বালকেরা অক্ষুণ্ণ কৌতুকে চেয়ে টের পায় নিমীল আলোয়
মানচিত্র ভেসে গেছে বেগুনি রঙের এক সমুদ্রের রোলে
সেই দেশে— কোনও এক নিচু আকাশের খোপে
আরও ক্ষুদ্রতর স্রোতে অদ্ভুত অসুস্থ এক মিউনিসিপ্যালিটির
জন্মেছিল কয়েকটি ধূসর দেয়াল— রাত্রি— দরিদ্রতা
প্যারাফিন-আলো— রুক্ষ ভাজা মাছ— ছবি— ঘাস— তুমি
অন্ধকার তা’কে ছিল আরক ও বৃশ্চিকের মৃতদেহে মেলানো শিশি’র
সমধিক নীরবতা।— তবুও জানালা দিয়ে আকাশের তুচ্ছ কুঠুরিতে
দেখা যেত ব্রহ্মহৃদয়; বলা যেত ঐ বৃষ— ঐ মৃগশিরা
আর্দ্রা— অগি— সরমা— রোহিণী— বানরাজা—
শহরের মেয়রের চেয়ে কিছু বড়ো ওরা হয়তো-বা
ন’ড়ে যায় টি-পার্টিতে— কিংবা অন্য চিক্কণ চিপটেনে
ময়দানের সমুজ্জ্বল বিমুক্তিতে ত্রিভুজ ও চতুর্ভুজ ক্লবে
মুখোমুখি পুরুষ-নারীর নীল নিট্ ক্লোজ-অপে।
এসে যেত হিম হাওয়া। অস্পষ্ট দৈত্যের মতো একা
তিন বার তিন ধনু দূর থেকে পাহাড়ের চূড়া
থেমে যেত— থেমেছে হঠাৎ যেন;— বরাবরই থেমে র’বে ব’লে
আমরাও থেমে গেছি— ডালমুট খেতে গিয়ে
হিম পকেটের থেকে হঠাৎ কমলালেবু
আধেক তুলিতে গিয়ে।— আমি-যে শিশুর পিতা— আরও ঢের দূরে
কোনও বড়ো নগরীর হেতুহেঁয়ালির মধ্য-নরকের ফাঁকে— বৃত্তাভাসে থাকি
অনেক জীবাণু ধুলো কৃকলাসদের মতো এসে বিছানার ‘পরে
আগাগোড়া খেয়ে ফেলে তবু যেই শিশুর-মায়ের
হৃদয়যন্ত্রকে ফেলে রেখে গেছে সময়ঘড়ির মুখে, ভুলে—
তাকে নিয়ে ঘর করি— নির্জন শীতের রাতে দম্পতির বিছানায় তাই
অনুকম্পা পা গলিয়ে ব’লে যায়: ‘খেলনার রঙিন দোকানে
সেলুলয়েডের মতো প্রেম হত;— তবু— তোমাদের—
রুধিরে জন্তুরও লিপ্সা নেই-‘
সেই সব জানো তুমি? সে-দিনও জানিতে তুমি? তুমি
কী ক’রে জন্ম নিলে— কী ক’রে জন্ম দেয় জীবনকে নারী
সেই সব প্রণালীর থেকে ঢের দূরে স’রে একা
তবুও রাত্রি এলে— নেউলের শরীরের মতন ধূসর
বিছানা রাখিতে পেতে— আঞ্জির-শাখার মতো অন্ধকারে তুমি।
আগাগোড়া নগরীর ভাঁড় আর মাতালের শপথকে
মোলায়েম ক’রে দিতে ভাঁড়ারের পনিরের মতো
দুই জন যুবকের জন্য শুধু। ‘তুমি এক জন?’—
তাই মৃত্যু হল তার হাতে সেই তুষের রঙের মতো ম্লান
বিছানার। গাটাপার্চা পুতুলের হে চিকুর জননী, তোমার—
তোমার সে-বৃশ্চিক— দেয়াল— লেবু— মাছ— প্যারাফিন
থুতমিতে হিম হাওয়া— বিকেলের কুয়াশায়
অকস্মাৎ আগন্তুক জেঠিমার মতো সেই পাহাড়ের
শেষ হল। রোজই দেখা যায়— তবু— মনে হয়
ঢের দিন বিদেশের অন্ধকারে ম’রে ছিলে তুমি।
সমুদ্রের ঐ পারে নদী আছে— নদীর ও-পারে
বাটামাছ ভাজে তারা জলপাই-তেলে
সেই ঘ্রাণ নিয়ে রাত্রি যেখানে উঠেছে জেগে
চেয়ারম্যানের মুখ— দরিদ্রতা— গোল শহরের
ম্লান আলো— ধূসর দেয়াল— ক্কাথ— কুজ্বটিকা— অহঙ্কার নিয়ে
তবুও তুমিও ছিলে সেইখানে—
মৃত্যু হল সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে তবু
অপারগ ধাত্রীর হাতে। অথবা কী ক’রে তার মৃত্যু হল
ধোঁয়াটে কাহিনী এক— আজ রাতে মনে নেই কিছু
আমি ছাড়া পৃথিবীতে আর কারু কিছু মনে নেই।
Comments
Post a Comment