আমার জীবন যেন
আমার জীবন যেন অন্তত এক স্থানে— একটি সূত্রের
বুনোনিতে ধরা দেয়— সর্বদাই নিসর্গের পথে আমি একা
নদীকে বেসেছি ভালো— বিশেষত স্তব্ধ হেমন্তের
অধিক নিশ্চল, স্থায়ী সলিলের প্রতিভাকে, আহা
যখন সে আমার জীবনে এসে মৌন মনোরেখা
হয়ে গিয়ে— তবু জল; যখন তাহার জলে কয়েকটি শর
অথবা শরের ভিড়ে বিকেলের আলো নেমে এলে
ইঁদুর-ধূসর জল কোনও এক চেনা রমণীর
কঙ্কালের মতো যেন— উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে মুহূর্তের বলে
আমার নিকটে থেকে— তার পর ঢের দূরে যায়
ক্ষিতিজ রেখার পারে,— সেইখানে আজ কোনও পাখি
নেই আর, আমাদের সকলের প্রবেশ নিষেধ
তবুও হেমন্ত ভালো আপনার লোকায়ত পথে
নদীর নিকট থেকে দূরে গিয়ে হলদে পাতার
পথের উপর দিয়ে— মানুষের শরীরের ছায়া
ক্ষুদ্র বামনের মতো এক অত্যন্ত বধির
অতীব বধির হয়ে সর্বদাই তবু
মানুষের শরীর ও প্রতিভাকে ব্যাপ্ত রেখে দেয়।
নিকটেই হেমন্তের উঁচু গাছে কালো সাদা ডোরা
গায়ে দিয়ে সমুজ্জ্বল, উৎসুক দোয়েল;
হলুদ খড়ের মাঝে এক জন দুই জন বিমূঢ় পাখির
অপ্রমেয় সতর্কতা— জোর পায় হয়তো লোষ্ট্রের
অথবা ডিমের ‘পরে ব’সে থেকে
তবুও কয়টি ডিম— অথবা ডিম কী ঢিল?
এই সব প্রশ্ন নিয়ে পাখিদের ঘুম
পাখিদের প্রেম— মৃত্যু— কে কবি কখন এসে হেমন্তের পলে
হঠাৎ দিয়েছে ভেঙে— অর্জুন-শাখার পিছে চাঁদ
কিংবা মানুষের চেয়ে অধিক বয়স্কতর ছায়া
অর্জুনের; একটি দুইটি ছায়া শেয়ালের মতো অবয়ব
প্রত্যাখ্যান ক’রে ফেলে এই সব মৌন, নমনীয়
পাখিদের প্রাণে এক হেমন্তের বীজ।
আমিও তেমন ছবি দেখে নিই— সূর্য ডুবে গেলে
অনেক দেরিতে চাঁদ উঠে এলে তিত্তিরাজ-গাছের ছায়ায়
কতগুলো বিজড়িত বিজৃম্ভিত ঘাস, চিল, ছায়ার উপরে
পায়চারি ক’রে ভাবি বহু ক্ষণ— সময়ের ঘড়ি
হাতের তালুর থেকে অপরূপ চাঁদের অঙ্গনে
তুলে দিয়ে— ভুলে গিয়ে— ভেঙে ফেলে তবু—
তবুও কে লোক কবে সময়ের কঠিন ঘড়িকে
ইশারায় চূর্ণ ক’রে এই সব পাখির মতন
ঘুমায়েছে— তবুও জানে নি তারা ঘুমায়েছে কী-না
তবুও জানে নি তারা সময়ের স্মরণীয় ঘড়ি
কোথাও প্রাক্কালে জন্মে— নাম-রূপে জেগে উঠে তবু
ম’রে গেছে— এই সব উঁচু-উঁচু গাছ— ছায়া— হেমন্তের ঘাস
এই দিকে বাংলা’র এঞ্জিনবিহীন, ন্যূব্জ খেতের উপরে
অঘ্রানের ধূর্ত চাঁদ ধীরে-ধীরে আমার হৃদয়ে
বিজড়িত হতে গিয়ে আরও ঢের স্থায়ী শঠতার
প্রয়োজন অনুভব ক’রে যায়— মায়াবীর বলে।
প্রয়োজন অনুভব করি আমি দূর পৃথিবীর
অবিস্মরণীয় সব ডাইনামো’র থেকে
বার হয়ে— এখানে হেমন্ত তার নিজ অর্থগুণে
যদিও আমার কেউ— কিছু নয়— হয়তো-বা— তবু
গুণময়; এই সব কথা ভেবে নিতে গিয়ে মেঘ
ধীরে-ধীরে ছেয়ে যায়— মানুষের মুখের উপরে
ছায়া তার— পকেটের থেকে আমি পুরোনো পিঙ্গল
ঘড়িটিকে বার ক’রে আধো-অন্ধকারে ব্যাপ্ত সময়ের দিকে
চেয়ে থাকি— যদিও সময় কারু কিছু নয়— তবু
মানুষের সাধারণ সুবিধার দিকে ফিরে থেকে
যেতে-যেতে চেয়ে দেখি এক-একটি গাছ
(সমস্ত আকাশ, নদী, প্রান্তরের পারে মাইলস্টোন
টেলিগ্রাফ-পোস্ট— তার— অবিরল রেলওয়ে-লাইন
নীল— ম্লান বেরিয়াল— কালভার্ট— ফ্যাক্টরির চোঙা
মানুষের কারুকর্মে সংসর্গের মতো মিশে গিয়ে
দাঁড়ায়েছে অপরূপ— তবুও সুবিধাবাদী নয়
অত্যধিক দুরারোহ ব’লে তারা মানুষের প্রাণে
স্বাভাবিক রুটিনের মতো কিছু নয়— তাই কোনও অন্তঃসার
নয়। হেমন্তের সারা-দিন এমনই গভীর স্বাভাবিক।
Comments
Post a Comment