এ-সব অনন্য কথা
এ-সব অনন্য কথা আমাকেই বলেছিল কোনও স্পর্শাতুর
আত্মা উঠে।— নদীর পারের পথে সবুজ বাড়ির এক শূন্য অবলঙ্
জানালার থেকে গ’লে।— এক দিন কার্তিকের চাঁদের আলোয়
স্টিমার-ঘাটের থেকে ফিরে আমি— নিকটের টিমটিমে বার’এ
কাঁচের গেলাস দেখে সহসা জলের লোভ অনুভব ক’রে
ঢুকি-কী-না-ঢুকি ভেবে— নির্জন বায়ুর ঢোঁক গিলে
শহরের পথ ছেড়ে দিয়ে এক অন্যতর পথে
নেমে গেছি— সেখানে ঝাউয়ের সারি যক্ষের সমুজ্জ্বল কুলুপের মতো
ছোট চাঁদটাকে বুকে আটকায়ে অনুভব ক’রে যেতেছিল
দুপুর-রাতের তৃপ্তি। ঝাড়নের মতো ন’ড়ে শকুনের শিশুদের রোল
কেবলই থামাতে চেয়ে সেই সব দীর্ঘ— দীর্ঘতর— গাছ যেন
করুণার অবতার— অভিজ্ঞ প্রবীণ এরা মানুষের প্রাণ
সেই সব ভয়াবহ ভাবে দারুরূপময় সুধীদের প্রাণে
নিজেও নির্জন সুধী হয়ে ক্রমে মিশে যেতে চায়।
আমাদের লুঘায়ুম, কার্মিলঙ্ নদীর নিকটে
শরের ভিতর থেকে জেগে উঠে দানবের মতো
চাঁদের বুড়িকে নিয়ে চরকা’র ঘুরঘুর ধ্বনি
বাতাসে বাজাতে চায় সারা-রাত— সর্বদাই সময়ের সুতো
কেটে ফেলে— সর্বদাই শকুনের খবিশ শিশুকে
চাঁদের দুরূহ আলো ধ’রে দিয়ে নদীর ও-পারে
অনেক মুমূর্ষু, মৃত মানুষের শব আছে ব’লে
যা হয়েছে— যা হতেছে— অথবা যা হবে পৃথিবীতে
এই সব গাছ জানে— এদের সংসর্গে এসে বিজড়িত হয়ে
শকুনেরা জানে কিছু— জানি আমি প্রত্যহ রাতেই
দ্বিতীয় প্রহর কেটে চ’লে গেলে— যখন তবুও
তৃতীয় নির্ঘণ্ট নেমে আসে নাই— এই সব দাঁতালো শকুন
দাঁড়কাক— শ্রীজ্ঞান দীপঙ্করের— হুয়েনৎসাঙের
কালো দাঁড়কাকগুলো— পরিব্রাজকের বাঁকা লাঠির মতন
এই সব ত্রিভঙ্গিম তক্ষক— উপরের বায়ু রোধ ক’রে
আদিম গাছের থেকে উদ্গীরিত হয়ে উঠে কিমাকার শাখার মতন
চাঁদের অনলে এসে দেখা দেয়— নদীর ভিতরে
যখন বাতাস শেষে অনেক চিকনপাটি বুনে
বিজড়িত হয়ে আসে— সহসা এদের বিম্ব পড়ে।
যা হয়েছে— যা হতেছে— অথবা যা হবে চির-দিন
চাঁদের ধবল বুড়ি জানে কিছু— আমরাও কিছু
জানি বটে। কিন্তু এই দানবীয় গাছগুলো আপামর সব
জেনে গেছে ব’লে তারা সর্বদাই শকুনের নীড়
কোলে রাখে— সর্বদাই মৃত, ভীত, মুমূর্ষুর শব
উদ্ঘাটিত ক’রে দেখে অগণন নক্ষত্রের ল্যাম্প’এ
চাঁদের প্রতিভা— হাওয়া— লুঘায়ুম— কার্মিলঙ্ নদীদের জল
প্রাণের নিকটে রাখে— অতীব অদ্ভুত এক জীব
এই কথা ব’লে গেল রাতের ভিতর থেকে ডেকে
নদীর পারের পথে সবুজ টালির ছাদে বাড়ি
কেউ কবে বানায়ে গেছিল যেন আলতাপাটি শিম-লতার ভিতর থেকে ছিঁড়ে তার বীজের মতন
ছোট ক’রে— ভিতরে মোমের পাশে মাথায় গাধার লম্বা টুপি
এঁটে নিয়ে— ডোরা-কাটা ছিপছিপে সাপের মতন
অদ্ভুত অন্যায় জামা গায়ে দিয়ে বিষণ্ন বামন
ব’সে আছে— পতঞ্জলি থেকে ক্রমে শুরু ক’রে শেলি
আবার নীঝঝে থেকে মার্কস, হলায়ুধ
পৃথিবীর সব জ্ঞান— কাজ— প্রেম— সাধ নিরলস
নিরভিসন্ধির মতো মনে ক’রে শতাব্দীর অমায়িক জল
চেয়েছে সে— এক চুল ভ্রান্তির অন্যায়ে তবু জলের গেলাস
কোথাও সে পায় নাই ব’লে আজও জল
নেই কারু। বস্তুত গেলাস কারু নেই।
Comments
Post a Comment