ইতিহাসযান
সেই শৈশবের থেকে এ-সব আকাশ মাঠ রৌদ্র দেখেছি;
এই সব নক্ষত্র দেখেছি।
বিস্ময়ের চোখে চেয়ে কতবার দেখা গেছে মানুষের বাড়ি
রোদের ভিতরে যেন সমুদ্রের পারে পাখিদের
বিষণ্ণ শক্তির মতো আয়োজনে নির্মিত হতেছে;
কোলাহলে— কেমন নিশীথ উৎসবে গ’ড়ে ওঠে।
একদিন শূন্যতায় স্তব্ধতায় ফিরে দেখি তারা
কেউ আর নেই।
পিতৃপুরুষেরা সব নিজ স্বার্থ ছেড়ে দিয়ে অতীতের দিকে
স’রে যায়— পুরোনো গাছের সাথে সহমর্মী জিনিসের মতো
হেমন্তের রৌদ্রে-দিনে-অন্ধকারে শেষবার দাঁড়ায়ে তবুও
কখনও শীতের রাতে যখন বেড়েছে খুব শীত
দেখেছি পিপুল গাছ
আর পিতাদের ঢেউ
আর সব জিনিস: অতীত।
তারপর ঢের দিন চ’লে গেলে আবার জীবনোৎসব
যৌনমত্ততার চেয়ে ঢের মহীয়ান, অনেক করুণ।
তবুও আবার মৃত্যু।— তারপর একদিন মউমাছিদের
অনুরণনের বলে রৌদ্র বিচ্ছুরিত হ’য়ে গেলে নীল
আকাশ নিজের কণ্ঠে কেমন নিঃসৃত হয়ে ওঠে;— হেমন্তের
অপরাহ্নে পৃথিবী মাঠের দিকে সহসা তাকালে
কোথাও শনের বনে— হলুদ রঙের খড়ে— চাষার আঙুলে
গালে— কেমন নিমীল সোনা পশ্চিমের
অদৃশ্য সূর্যের থেকে চুপে নেমে আসে;
প্রকৃতি ও পাখির শরীর ছুঁয়ে মৃতোপম মানুষের হাড়ে
কী যেন কিসের সৌরব্যবহারে এসে লেগে থাকে।
অথবা কখনও সূর্য— মনে পড়ে— অবহিত হয়ে
নীলিমার মাঝপথে এসে থেমে র’য়ে গেছে— বড়ো
গোল— রাহুর আভাস নেই— এমনই পবিত্র নিরুদ্বেল।
এই সব বিকেলের হেমন্তের সূর্যছবি— তবু
দেখাবার মতো আজ কোনও দিকে কেউ
নেই আর, অনেকেই মাটির শয়ানে ফুরাতেছে।
মানুষেরা এই সব পথে এসে চ’লে গেছে,— ফিরে
ফিরে আসে;— তাদের পায়ের রেখায় পথ
কাটে কারা, হাল ধরে, বীজ বোনে, ধান
সমুজ্জ্বল কী অভিনিবেশে সোনা হয়ে ওঠে— দেখে;
সমস্ত দিনের আঁচ শেষ হলে সমস্ত রাতের
অগণন নক্ষত্রেও ঘুমোবার জুড়োবার মতো
কিছু নেই;— হাতুড়ি করাত দাঁত নেহাই তুর্পুন্
পিতাদের হাত থেকে ফিরেফির্তির মতো অন্তহীন
সন্ততির সন্ততির হাতে
কাজ ক’রে চ’লে গেছে কত দিন।
অথবা এদের চেয়ে আরেক রকম ছিল কেউ-কেউ;
ছোটো বা মাঝারি মধ্যবিত্তদের ভিড়;—
সেইখানে বই পড়া হত কিছু— লেখা হত;
ভয়াবহ অন্ধকারে সরু সলতের
রেড়ির আলোর মতো কী যেন কেমন এক আশাবাদ ছিল
তাহাদের চোখে মুখে মনের নিবেশে বিমনস্কতায়;
সংসারে সমাজে দেশে প্রত্যন্তেও পরাজিত হ’লে
ইহাদের মনে হত দীনতা জয়ের চেয়ে বড়;
অথবা বিজয় পরাজয় সব কোনও-এক পলিত চাঁদের
এ-পিঠ ও-পিঠ শুধু;— সাধনা মৃত্যুর পরে লোকসফলতা
দিয়ে দেবে; পৃথিবীতে হেরে গেলে কোনও ক্ষোভ নেই।
*
মাঝে-মাঝে প্রান্তরের জ্যোৎস্নায় তারা সব জড়ো হয়ে যেত—
কোথাও সুন্দর প্রেতসত্য আছে জেনে তবু পৃথিবীর মাটির কাঁকালে
কেমন নিবিড়ভাবে বিচলিত হয়ে উঠে, আহা।
সেখানে স্থবির যুবা কোনও-এক তন্বী তরুণীর
নিজের জিনিস হতে স্বীকার পেয়েছে ভাঙা চাঁদে
অর্ধ সত্যে অর্ধ নৃত্যে আধেক মৃত্যুর অন্ধকারে;
অনেক তরুণী যুবা— যৌবরাজ্যে যাহাদের শেষ
হয়ে গেছে— তারাও সেখানে অগণন
চৈত্রের কিরণে কিংবা হেমন্তের আরও
অনবলুণ্ঠিত ফিকে মৃগতৃষ্ণিকার
মতন জ্যোৎস্নায় এসে গোল হয়ে ঘুরে-ঘুরে প্রান্তরের পথে
চাঁদকে নিখিল ক’রে দিয়ে তবু পরিমেয় কলঙ্কে নিবিড়
ক’রে দিতে চেয়েছিল,— মনে মনে— মুখে নয়— দেহে
নয়; বাংলার মানসসাধনশীত শরীরের চেয়ে আরও বেশি
জয়ী হয়ে শুল্ক রাতে গ্রামীণ উৎসব
শেষ ক’রে দিতে গিয়ে শরীরের কবলে তো তবুও ডুবেছে বার-বার
অপরাধী ভীরুদের মতো প্রাণে।
তারা সব মৃত আজ।
তাহাদের সন্ততির সন্ততিরা অপরাধী ভীরুদের মতন জীবিত।
‘ঢের ছবি দেখা হল— ঢের দিন কেটে গেল— ঢের অভিজ্ঞতা
জীবনে জড়িত হয়ে গেল, তবু, হাতে খননের
অস্ত্র নেই— মনে হয়— চারি দিকে ঢিবি-দেয়ালের
নিরেট নিঃসঙ্গ অন্ধকার’— ব’লে যেন কেউ যেন কথা বলে।
হয়তো সে বাংলার জাতীয় জীবন।
সত্যের নিজের রূপ তবুও সবের চেয়ে নিকট জিনিস
সকলের; অধিগত হলে প্রাণ জানালার ফাঁক দিয়ে চোখের মতন
অনিমেষ হয়ে থাকে নক্ষত্রের আকাশে তাকালে।
আমাদের প্রবীণেরা আমাদের আচ্ছন্নতা দিয়ে গেছে?
আমাদের মনীষীরা আমাদের অর্ধসত্য ব’লে গেছে
অর্ধমিথ্যার? জীবন তবুও অবিস্মরণীয় সততাকে
চায়; তবু ভয়— হয়তো-বা চাওয়ার দীনতা ছাড়া আর কিছু নেই।
ঢের ছবি দেখা হল— ঢের দিনে কেটে গেল— ঢের অভিজ্ঞতা
জীবনে জড়িত হয়ে গেল, তবু, নক্ষত্রের রাতের মতন
সফলতা মানুষের দূরবীনে র’য়ে গেছে,— জ্যোতির্গ্রন্থে;
জীবনের জন্যে আজও নেই।
অনেক মানুষী খেলা দেখা হল, বই পড়া সাঙ্গ হল— তবু
কে বা কাকে জ্ঞান দেবে— জ্ঞান বড়ো দূর পৃথিবীর
রুক্ষ গল্পে; আমাদের জন্যে দূর— দূরতর আজ।
সময়ের ব্যাপ্তি যেই জ্ঞান আনে আমাদের প্রাণে
তা তো নেই; স্থবিরতা আছে— জরা আছে।
চারি দিক থেকে ঘিরে কেবলই বিচিত্র ভয় ক্লান্তি অবসাদ
র’য়ে গেছে। নিজেকে কেবলই আত্মক্রীড় করি; নীড়
গড়ি। নীড় ভেঙে অন্ধকারে এই যৌন যৌথ মন্ত্রণার
মালিন্য এড়ায়ে উৎক্রান্ত হতে ভয়
পাই। সিন্ধুশব্দ বায়ুশব্দ রৌদ্রশব্দ রক্তশব্দ মৃত্যুশব্দ এসে
ভয়াবহ ডাইনীর মতো নাচে— ভয় পাই— গুহায় লুকাই;
লীন হতে চাই— লীন— ব্রহ্মশব্দে লীন হয়ে যেতে
চাই। আমাদের দু’হাজার বছরের জ্ঞান এ-রকম।
নচিকেতা ধর্মধনে উপবাসী হয়ে গেলে যম
প্রীত হয়। তবুও ব্রহ্মে লীন হওয়াও কঠিন।
আমারা এখনও লুপ্ত হই নি তো।
এখনও পৃথিবী সূর্যে সুখী হয়ে রৌদ্রে অন্ধকারে
ঘুরে যায়। থামলেই ভালো হত— হয়তো-বা;
তবুও সকলই উৎস গতি যদি,— রৌদ্রশুভ্র সিন্ধুর উৎসবে
পাখির প্রমাথী দীপ্তি সাগরের সূর্যের স্পর্শে মানুষের
হৃদয়ে প্রতীক ব’লে ধরা দেয় জ্যোতির পথের থেকে যদি,
তা হলে যে আলো অর্ঘ্য ইতিহাসে আছে, তবু উৎসাহ নিবেশ
যেই জনমানসের অনির্বচনীয় নিঃসঙ্কোচ
এখনও আসে নি তাকে বর্তমান অতীতের দিকচক্রবালে বার-বার
নেভাতে জ্বালাতে গিয়ে মনে হয় আজকের চেয়ে আরও দূর
অনাগত উত্তরণলোক ছাড়া মানুষের তরে
সেই প্রীতি, স্বর্গ নেই, গতি আছে; তবু
গতির ব্যসন থেকে প্রগতি অনেক স্থিরতর;
সে অনেক প্রতারণাপ্রতিভার সেতুলোক পার
হল ব’লে স্থির;— হতে হবে ব’লে দীন, প্রমাণ, কঠিন;
তবুও প্রেমিক— তাকে হতে হবে; সময় কোথাও
পৃথিবীর মানুষের প্রয়োজন জেনে বিরচিত নয়; তবু
সে তার বহির্মূখ চেতনার দান সব দিয়ে গেছে ব’লে,
মনে হয়; এর পর আমাদের অন্তর্দীপ্ত হবার সময়।
পূর্বাশা। বৈশাখ ১৩৫৩
Comments
Post a Comment