মনে হল

মনে হল শিশুরা আমার গল্প শুনেছে অনেক দিন
তার পর বড়ো হয়ে এই বার তাহাদের আর কোনও ঋণ
আমার নিকটে আর নাই
কিংবা যদি থেকে থাকে আমি তাতে সব-চেয়ে বেশি অবসাদ বোধ করি
অনেক সময় রেখে বিশেষ ফাজিল যেন হয়ে গেছে মণিবন্ধে ঘড়ি
এ-বার নতুন মডেল কিছু চাই

গল্প আমি ব’লে গেছি— অন্ধকার জলের ভিতরে থেকে মাছ
কী ক’রে উদ্ৰিক্ত ক’রে চ’লে যায় মানুষের মতো ঘানিগাছ
তাহাদের দাম্পত্য থাকিতে পারে— তবুও রুটিন
নাই কিছু— কিংবা আছে— তবু তাহা নয় বকযন্ত্র, ধর্মবক
যদিও জলের তলে রয়েছে অনেক কুশান, হূন, পহ্লবী ও শক
তবুও সিন্ধুর জল পান ক’রে মুক্তকচ্ছ মীন

কিংবা আমি কোনও দিন বর্ষাক্ষান্ত আষাঢ়ের সাদা ছেঁড়া মেঘে
দেখেছি বিকেলবেলা— একটা ধবল বক— ঢের উঁচু— মনের আবেগে
উড়ে যায় পূর্বের দিকে
আর-একটা সাদা বক চ’লে যায় ক্রিসক্রস ক’রে তারে পশ্চিমের পানে
কোনও রেলস্টেশনের এত বড়ো প্ল্যাটফর্ম দেখি নাই— এত স্থির অমোঘ সন্ধানে
চশমা আঁটিতে আমি দেখি নাই সেরেস্তায় কোনও বিষয়ীকে

আমার হয়েছে মনে আপনারে, কার্ল মার্কস— আর তুমি মনোবিকলন
আষাঢ়-বিকেলে সেই বৃষ্টিশেষে— অদ্ভুত ক্ষান্তির বিজ্ঞাপন
মাইলের-পর-মাইল তুলোর বলের মতো মেঘ
মাইলের-পর-মাইল— অনন্ত অসীম মাইল আকাশের সিনোটাফ— নিস্তব্ধতা:
যেন কোনও ব্র্যাডম্যান মুখোমুখি এসে ভাবে: ক্রিকেটের দুরবগাহতা
যেখানে গণিত শুধু— এখানে বিবেক

গল্প আমি ব’লে গেছি— হয়তো-বা কোনও এক শিশু— শৈশব
জননীর পাশে শুয়ে ধূসর গাধার পিঠ করে অনুভব
যেন মনে হয়
ঢের মিছরির দানা, ঢের লজেনচুস খেয়ে তবু সব-চেয়ে আগে
যে পাশে রয়েছে শুয়ে সদ্যকাটা ইলিশের মতো মেছো, মিঠে অনুরাগে
সে যেন মারণ, মৃত, অশ্রু ও বিস্ময়।

শিশুটির চোখে তাই ঘুম যেন আসে না ক’ আর
এর চেয়ে কেউ যদি জেগে উঠে দিত তারে বেদম প্রহার
যদি কোনও দানবের মুখ
মশারির ঐ পারে দেখা দিত— মকর সে— ইলিশের মতো নত চোখে
রেড়ির তেলের দীপ মৃত ম্লান— নৃমুণ্ডের মিথ্যে নিয়ে ভিতরে ঢুকুক

এই সব রঙ তার রক্তে কাঁটা দিয়ে যায় বটে
তবু জানে তরবার আছে এক সাহেব-মেমের নিকটে
দানবেরা ম’রে যায়
ছোট-ছোট ছেলেরাও বডকিন দিয়ে বড়ো রাক্ষসকে মারে
কিন্তু যে-জননী পাশে শুয়ে আছে— ঘুমায়েছে?— কিছুতেই তারে
পাওয়া যায় না ক’ কোনও কূলকিনারায়।

বয়ঃসন্ধি বোঝে না ক’— তখন সে পেয়ে গেছে যাদবের দেহ
বয়স্কেরা অনুভব করে না ক’— তাদের জন্মেছে শোথ, যক্ষ্মা, প্রমেহ
কিন্তু তবু শিশুদের মনে
মৃত্তিকার টান যেন রাশভারি পরিপক্ক বাতাবি’র প্রতি
বধির ব্যথায় এক মিশে থাকে— ভগ্ন চোয়ালের কোনও নাই অব্যাহতি
যেন এক আলপিন চির-দিন ব্যস্ত মেরুসমুদ্র খননে

কিন্তু কেউ এই সব গল্প ঠিক বোঝে না ক’— দেয় না ক’ মন
কারণ শিশুরা কেউ পড়ে না ক’ এ-সব লিখন
যখন তাহারা বই পড়ে
তখন হয়েছে তারা ধনুর্ধর যাদবসন্তান
কিংবা অৰ্জুনের মতো, হায়,— গাণ্ডিবেও নাই আর প্রাণ
যাদবনারীরা সব পতঙ্গের মতো চোখে ঝরে

এই সব গল্প আমি বলিয়াছি এক দিন— হয়তো-বা আপনার-ই হৃদয়ের তরে
তার পর মাছরাঙাটির মতো সারা-রাত লুকায়েছি সাত-রঙ্ আঁধার বিবরে
তবুও নিজের প্রাণ— পৃথিবীর প্রাণ
জানি আমি, কোনও ব্যথা গূঢ় অনুভব এক: ছায়া শুধু;— পিণ্ড থাকে পিছে
যাহারা টেবিলে ব’সে টোস্ট মার্মালেড ডিম খায় সেই পিণ্ডগুলো মিছে
অন্যমনস্কতা আনে অন্য এক স্থির অভিজ্ঞান

এটা বিতর্কের যুগ— রহস্যকে ক্লীব বলে— কল্পনাকে ভেবেছে চশম
তবুও একটা যুগে মাস্টোডন ফুল হয়ে— ফল হয়ে— জাঁতার ভিতরে ঢুকে গম
গুঁড়ো হয়ে যায়
ক্রমে-ক্রমে মানবেরা জেগে ওঠে— মানুষের আয়ু শেষ হয়
তার পর জলমাকড়ের ঠ্যাং: রাজর্ষিও হয়ে পড়ে অনন্য-উপায়
নিচে নেমে যায়— ম’রে যায়— জাঁতাটা ঘুরিবে তবু যত দিন গোধূম ঘুরায়।

কোনও যুগে কেউ যদি শিশির-বালিশে শুয়ে তিলের-মতন-ঘুণাক্ষর
অনুভূতি বোধ ক’রে পায় না ক’ কাছে আর দ্বিতীয় দোসর
এর চেয়ে বন্যা ভালো— মরুর সিমুম
এর চেয়ে ভূমিকম্প ভালো যেন— আগ্নেয় উৎপাত
এই কথা মনে যদি হয় তার সারা-দিন-রাত
তা হলে সে তিসি, তিল নয় ঠিক পাশবালিশের সাথে ঘুম।

ভিজে চাদরের ‘পরে লণ্ঠন-লেকচার শোন গণসাধারণ: বলিদ্বীপবাসিনী নারী বিবর্তনে ঘুরে
জলমাকড়ের মতো ঠ্যাঙে বোঁ-বোঁ ক’রে, চেয়ে দেখ, ঘুরিছে পুকুরে
গাজন-জনবসতিও ম’রে গেছে ব’লে
কিংবা দেখ— হয়তো-বা— হাঙরেরা হাতি’রাও মরিল না— খানিকটা হল রাতকানা
দরকার হল তাই তাহাদের সারা-রাত স্প্রিঙের দস্তানা
এই সব সার্কাসের দিনগুলো তবু শেষ হলে

ইহাদের বুকে যেই ব্যথা, নিষ্ফলতা, নিঃসঙ্গতা
খানিকটা হাতুড়ির ঘায়ে চেতনার তাড়নায় জানায়ে গিয়েছে নিজ প্রথা
এ-দিকের সে-দিকের পেরেকে-পেরেকে
যেন এসে ধােপানির বিছানায় শুয়ে থাকে বৃশ্চিক-জননীর মতো
পাশে শিশু— হে বীজ, অনাদি বীজ— কোটি বছরের বুড়ো হয়ে গিয়েছ তো
বর্ষাক্ষান্ত বৈকালে এই বার পাখি দু’টো উড়ে গেল বিপরীত দিকে

তবুও এ-সব কথা দীক্ষিতের তরে যেন— খানিকটা বীজের মতন
চারি-দিকে জনগণমানসের প্রথম চেতন
এই সব কথা শুনে খায় থতমত
তা হলে কী ক’রে মিস্ত্রি চামার ছুতার রুটি-বিক্রেতার ঘরে
মহামানুষের সব জন্ম হল— কী ক’রে তাদের প্রীত ফাইল নড়ে-চড়ে
সেই সব তুমি দেখেছ তো—

Comments

সর্বাধিক পঠিত কবিতা

যত দূর চোখ যায়

তবুও সে আসবে না আর

এইখানে প্যাকাটির মতো

আকাশের চাঁদ

যাত্রী

পটভূমি

সূর্য রাত্রি নক্ষত্র

রবীন্দ্রনাথ

পটভূমির ভিতরে গিয়ে

নারীসবিতা