হেমন্ত-বিকাল

সে এক প্রাচীন আলো দেখা দেয় উঁচু পিপুলের ডালে— নদীর নিকটে
বৎসরের এ-সময়ে— হেমন্ত এসেছে তার আধাে-ভিজে মৃত্তিকায় করুণার অবতার হয়ে
কোথাও কৃষক নাই কোনও দিকে— বিপর্যস্ত খড়ের সোনায়
পরিত্যক্ত কাস্তের রূপে পৃথিবীকে কাছে দেখা যায়
বসেছে সুস্বাদু শীতে ঠেস দিয়ে— সব হবে— সব হবে ধীরে
বিকেলের সূর্য তারে আধাে-চেনে, দুইটি ঘুঘু’র সাথে মিশে গিয়ে হরীতকী-অরণ্যের দিকে পিছ ফিরে
তাহারে নিবিড় ক’রে চিনেছিল হয়তো-বা পৃথিবীর নষ্ট গ্রন্থাগার

কৃষাণপুরুষ তবু সূর্য আজও— হেমন্তের বিকেলের পথে
লয়েছে সোনা’র আঁটি কাঁধে তুলে খোলা মাঠ বেছে নিয়ে বাংলা’র পাড়াগাঁ’র হ্রদে
সমস্ত দুপুর ভ’রে ক্ষয়িষ্ণু তীক্ষ্ণতা তার জ্ব’লে গেছে নির্জন পারদে
নিকটে আশ্রয় ছিল— সাদা পায়রা’র ভিড়— অনন্ত ঢেঁকির শব্দ— ধান্যের ঘ্রাণ
উন্নত পেঁপে’র গাছ সমীক্ষা করেছে সব দানবীয় চোখ তুলে— অপস্রিয়মাণ
বিকেলের কোমল আলোয় তার মেধা যেন লুপ্ত পৃথিবীর
মৃত গ্রন্থাগার থেকে শুষিতেছে যাহা সব পরাজিত ধর্ষিত বধির।

নলখাগড়ার দেশে— ঝাউয়ের আভার পিছে— নদীর ও-পারে— গোল সূর্য বিদূষক।
শ্রমণের মুণ্ড তুলে; তবু সে সন্ন্যাসী নয়। অনাদির আদিম কৃষক
আজিজের গোরু’র গাড়িকে আজও চালাতেছে আঙুল ঘুরায়ে গোল পথে
চারটে বলদ আছে— ঘুরিছে নিম্নতর জ্যামিতির তেলচিটে বৃত্তের সাথে
সাদা-সাদা কড়ির মতন সব পাতিহাঁস—
চোখ দিয়ে কুড়ায়ে আনিলে তা’রা হয়ে থাকে হৃদয়ের নিস্তব্ধ— কড়ির
ট্যারা চোখে এক-আধ বার তা’রা দেখে নেবে প্রগলভ সূর্যকে
যেন কবেকার দূর উপকাহিনির সব সমীচীন হংসী’দের মতো তা’রা মানবীয় আত্মার প্রতীক।

হেমন্তের প্রত্যাসন্ন আঁধারকে জ্ঞান দেবে
সারা-দিন বক্র ভগ্ন রীতির মতন সব মূঢ় দাঁড়কাক
পড়েছিল পথে-পথে— এখন পেতেছে তা’রা সব যেন লঘু আঁধারের টানে
প্রবীণ সঙ্গতি পক্ক সুর— যখন চুম্বক এসে চুমো খায়
মদির বকের দল ধবল লণ্ঠন লয়ে অবিমৃশ্যকারী স্থির ধাতুর সন্ধানে
আকাশরেখায় ক্রমে মিশে যায়;—
এইখানে পৃথিবীর ঘাসে
রয়েছে প্রক্রিয়া আরও— সম্পন্ন হয় নি যার সব রীতি অন্তঃসত্তা দিগন্ত আকাশে
পুকুরের থেকে রোদ উঠে এসে নৃত্য ক’রে গেছে বহু ক্ষণ
যেন সব সমুৎপন্ন বাঘিনি’রা খেলে গেছে আমার এ-হৃদয়ের প্রস্তরের সাথে
তারে ধূম্র জেনে— তাহার ফাটলে তবু পিঙ্গল রেখা দেখে মৃত্যুসমৃদ্ধির
পেয়ারা’র ফাঁক থেকে চুঁয়ে আলো হয়ে গেছে কালো জল, চকোলেট পাতাদের ভিড়।

আমার পায়ের নিচে— হেমন্তের সন্ধ্যায়— পরথুপি ঘাসের উপরে
এখুনি নিভিবে সব— এই সব রৌদ্রবিম্ব চ’লে যাবে বোলতা’র পাখনায় উড়ে
(তিনটে তুড়ির শব্দে); মানুষের কোটের পকেট ভ’রে ছবি হতে
ঐ দূর উঁচু-উঁচু হরিতকী-শাখারা এ-বার
স্বর্ণকে বিদায় দেয়— বিবর্ণ খড়ের মাঠ কমলারঙের মেঘে হতেছে আলোক
শেয়াল তা ধুম্র মুণ্ডে জেনে গেছে— হামিদের সাদা লাল ঘোড়া’দের স্থিরতম দূরবিন-চোখ
এমন আশ্চর্য রঙে— অঘ্রানের বিকেলের— সহসা প্রবেশ যেন করে

গভীর সমূর্তি নিয়ে— সময়ের অভিপ্রেত কক্ষের ভিতরে
টিয়া’রা গিয়েছে উড়ে— তাদের পাখার ঘ্রাণ লেগে আছে মটরের খেতে
তখন ইঁদুর এক ডিমের মতন সাদা চাঁদের নিবিড় রৌদ্রে তেতে
জৈমিনি’র মতো পেঁচা প্রবীণ আত্মার মতো চাঁদ থেকে হামাগুড়ি দিয়ে নেমে উড়ে যেতে-যেতে
থেমে গেল পিপুলের জানালায়। জটিল স্বপ্নের ডিম আমারও নাকের অগ্রভাগে
হৈমন্তিকি, তোমাদের সকলের জন্ম হয়েছিল যেন নিওলিথ পৃথিবীর আগে—
প্রেম এসেছিল বুকে। যারা আজও দিকে-দিকে পিরামিড ভাঙে আর গড়ে
তোমাদের জন্ম হয়েছিল যেন তাহাদের মরণের লক্ষ যুগ পরে।

Comments

সর্বাধিক পঠিত কবিতা

যত দূর চোখ যায়

তবুও সে আসবে না আর

এইখানে প্যাকাটির মতো

আকাশের চাঁদ

যাত্রী

পটভূমি

সূর্য রাত্রি নক্ষত্র

রবীন্দ্রনাথ

পটভূমির ভিতরে গিয়ে

নারীসবিতা